হামাসের সামরিক প্রধানের ওপর হামলার দাবি ইসরাইলের, নিহত ৭১ ফিলিস্তিনি
Share on:
ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মুহাম্মদ দেইফ এবং তার সেকেন্ড ম্যানের ওপর দক্ষিণ গাজা উপত্যকায় বিমান হামলা দাবি করেছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী।
হিব্রু আউটলেটগুলোতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজনৈতিক নেতাদের উদ্ধৃত করে মুহাম্মদ দেইফকে হত্যার আশঙ্কা জানিয়েছে।
তবে হামাস জানিয়েছে, এ হামলায় তাদের কোনো নেতা নিহত হননি।
এদিকে গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শনিবার দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের পশ্চিম এলাকায় আল মাওয়াসিতে ইসরাইলি বিমান হামলায় ৭১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ হামলায় আহত হয়েছে ২৮৯ জনেরও বেশি।
যে জায়গাটিতে হামলা চালানো হয়েছে, সেটিকে আগে থেকেই ‘সেফ জোন’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল ইসরাইল।
এই ঘটনার পর ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বলছে, তারা এই হামলার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
ইসরাইলের গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, হামাসের সিনিয়র নেতা মোহাম্মদ দেইফ এই হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সারাদিন নিরাপত্তা নিয়ে তাদের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করছিলেন বলেও বার্তাসংস্থা রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, যেখানে বিমান হামলা হয়েছে সে জায়গাটি দেখে মনে হচ্ছে সেখানে ‘ভূমিকম্প’ আঘাত হেনেছে।
ওই এলাকার একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ধোয়াচ্ছন্ন ধ্বংসাবশেষ থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় হতাহতদের স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অনেকেই আবার ধংসস্তুপ সরিয়ে সেখান থেকে অনেককে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
যেখানে হামলা চালানো হয়েছে তার পাশেই থাকা কুয়েত ফিল্ড হাসপাতালের কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, সেখানে আহত অনেকেই মেঝেতে পড়ে আছেন। আহতদের চিকিৎসা করানো নিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল।
হামাসের এক কর্মকর্তা দাবি করেন, এই হামলার ভয়াবহতা দেখে মনে হচ্ছে ইসরাইল একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে যেতে আগ্রহী নয়।
হামাসের সামরিক শাখা আল কাশেম ব্রিগেডের প্রধান মোহাম্মদ দেইফ এখন ইসরাইলি হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু বলে ইসরাইলি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী সংগঠন হামাস যে হামলা করেছিল, তার প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে বলেই মনে করা হয় তাকে। ওই হামলায় এক হাজার ২০০ ইসরাইলি নিহত হয়েছিল। একই সময় পণবন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ২৫১ জনকে।
এরপর ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজায় যে হামলা চালিয়েছে তাতে ৩৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে জানাচ্ছে গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এর আগে গত সপ্তাহে গাজার খান ইউনিসে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ২৯ জন নিহত হয়েছে। সেখানকার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওই হামলায় আরো অনেক মানুষ আহত হয়।
লিফলেট বিতরণ করে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ
গাজার উত্তরে অভিযানের মধ্যেই গত বুধবার গাজা শহরের বাসিন্দাদের দক্ষিণে চলে যেতে বলেছিল ইসরাইলি সামরিক বাহিনী।
উড়োজাহাজ থেকে লিফলেট ফেলে গাজার বাসিন্দাদের কাছে এই অনুরোধ জানায় ইসরাইলি বাহিনী। সেখানে গাজা শহরকে বিপজ্জনক যুদ্ধ এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।
দেইর আল-বালাহ এবং আল-জাওয়াইদা এই দু’টি রাস্তা দিয়ে তাদের নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
ইসরাইলের এই ঘোষণার পরই এ নিয়ে উদ্বেগ জানায় জাতিসঙ্ঘ। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো, গাজাবাসীদের এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইল।
এদিকে গত দুই সপ্তাহে ইসরাইলি বাহিনী গাজার কয়েকটি এলাকায় আবারো প্রবেশ করেছে। ইসরাইলি যোদ্ধাদের ধারণা, হামাসের যোদ্ধারা আবারো সংগঠিত হচ্ছে গাজার বিভিন্ন জায়গায়।
তবে হামাস বলছে, যুদ্ধবিরতি আলোচনার মধ্যেই ইসরাইলি বাহিনী যে তৎপরতা চালাচ্ছে তা যুদ্ধবিরতি এবং বন্দী মুক্তির আলোচনাকে আরো দীর্ঘায়িত করছে।
যুদ্ধবিরতির ওই আলোচনায় মিসর, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি কাতারের প্রধানমন্ত্রীও অংশ নিচ্ছেন।
হামাসের শীর্ষ কর্মকর্তা হোসাম বদরান এএফপিকে বলেন, ‘ইসরাইল বোমা হামলা, বাস্তুচ্যুতি এবং গণহত্যা জোরদার করে আবার আলোচনার জন্য চাপ দেয়ার চেষ্টাও করছে।’
পথে পথে মৃত্যু ও ধংসস্তুপ
গাজার তাল আল সুলতান এলাকার প্রতিটি রাস্তাঘাট, বাড়িঘর এমনি ফাঁকা জায়গা সব কিছুই যেন ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
রাস্তার পথে পথে কিংবা খোলা জায়গায় পড়ে আছে মানুষের শরীর, কোথাও আবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাত পা বা শরীরের বিভিন্ন অংশ। যাদের সবাই বুলেটের আঘাতে নিহত হয়েছে বলেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
আবার ধংসস্তুপের ইট পাথরের এতটাই ভেতরে পড়েছিল লাশগুলো যে সেখানে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর কোনো সুযোগই নেই।
গাজার বেসামরিক কর্তৃপক্ষ এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বাতাস থেকে ভেসে আসছে লাশের গন্ধ, আবার যেকোনো মুহূর্তেই ঘটতে পারে বিমান হামলা। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও চলছে উদ্ধারকাজ।
পূর্ব গাজা শহরের শেজাইয়া কিংবা দক্ষিণে রাফাহর কাছে তাল আল-সুলতানে গত কয়েক দিন এতটা ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে যে আহতদের নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সগুলোও চলাচলের সাহস করছিল না।
গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা মুহাম্মদ আল মুগায়ের বলেন, ‘ইসরাইলিরা যে জায়গাগুলোতে দখল নিয়েছে তার কাছাকাছি এলাকায় প্রবেশ করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তবুও আমরা মানুষের জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
যুদ্ধ বিরতি আলোচনা কতদূর
গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে হামাসের দেয়া নতুন প্রস্তাব এবং এ নিয়ে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ডেভিড বার্নিয়ারের কাতার সফরকে যুদ্ধবিরতির সম্ভাব্য চুক্তির ক্ষেত্রে ‘বড় অগ্রগতি’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তবে বেশ কয়েক দিন ধরে এটি নিয়ে আলোচনা হলেও চুড়ান্ত কোনো আলোচনায় পৌঁছাতে না পারায় গাজায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে।
নতুন প্রস্তাবে হামাস কাছে থাকা ইসরাইলি পণবন্দীদের মুক্তির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে বলে বার্তাসংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে।
গত সপ্তাহে মোসাদের প্রধান ডেভিড বার্নিয়ার কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল-থানির সাথে যুদ্ধবিরতির আলোচনার জন্য দোহা সফর করেন।
গত ১ জুন গাজায় যুদ্ধবিরতি-সংক্রান্ত একটি তিন ধাপের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
ওই প্রস্তাব অনুসারে, প্রথম ধাপে গাজায় ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হবে। সেখানে রাফাসহ গাজার অন্যান্য জনবহুল এলাকাগুলো থেকে সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয়া হবে এবং ইসরাইলের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী কয়েক শ’ ফিলিস্তিনির মুক্তির বিনিময়ে নিজেদের কাছে থাকা কয়েকজন পণবন্দীকে মুক্তি দেবে হামাস।
এই যুদ্ধবিরতি আলোচনা এখনো সফলতায় পৌঁছায়নি। তবে গাজায় একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। এতে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছেই।
সূত্র : আল জাজিরা, বিবিসি, টাইমস অব ইসরাইল
এনএইচ