বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমা নিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আইনের বাধ্যবাধকতায় একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারবে না। আর শেয়ারের ধারণকৃত মূল্য নির্ধারণ করা হয় বাজার মূল্যের ভিত্তিতে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমা নিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
আইনের বাধ্যবাধকতায় একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারবে না। আর শেয়ারের ধারণকৃত মূল্য নির্ধারণ করা হয় বাজার মূল্যের ভিত্তিতে।
ব্যাংকগুলোর ধারণকৃত শেয়ারের মূল্য বাজারে বেড়ে গেলে আইনের বাধ্যবাধকতা অমান্য হয়ে যায়। আর রাতারাতি শেয়ার বিক্রি করে নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনা যায় না।
আবার নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করলেই ব্যাংকগুলোকে জরিমানা গুনতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। এভাবে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ার ধারণের সর্বশেষ সীমা নিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়েছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির শিথিলতায় ২০০৯ সালে কৃষি ও এসএমই ঋণের বড় একটি অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছিল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২০১০ সালে কঠোর তদারকির মধ্যে নিয়ে আসে ব্যাংকগুলোকে। ফলে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের ধস নামে।
আগে ব্যাংকগুলো তার মোট দায়ের ১০ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বা শেয়ার ধারণ করতে পারতো।
মোট দায় বলতে, ব্যাংকগুলোর মূলধন বাদে সব সম্পদের মূল্যের যোগফল বোঝাতো। ওই সময় ব্যাংকগুলোতে ৫ লাখ কোটি টাকার মোট সম্পদ ছিল।
সে হিসাবে ২০১০ সালের আগে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে শেয়ার ধারণ করেছিল। কিন্তু ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ভয়াবহ দরপতনের পর থেকে ব্যাংকগুলোর মূলধন কমতে থাকে।
এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর জন্য পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করাকড়ি আরোপ করে। এরই ফাঁকে ২০১৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়।
সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলো তার মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারবে না।
এখন মোট মূলধন বলতে বোঝায় ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি, রিটেইন আর্নিং ও শেয়ার প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্টের সমন্বয়ে যে অর্থ থাকবে তাই।
এ আইন সংশোধনের আগে তখন ব্যাংকিং খাতে মোট সম্পদ ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। এর ১০ শতাংশ হিসেবে ৫০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ছিল পুঁজিবাজারে।
কিন্তু যখন আইন সংশোধন করা হয় তখন মোট মূলধন নেমে আসে ৫০ হাজার কোটি টাকার। এর ২৫ শতাংশ হিসাবে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার কথা সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার। আইন সংশোধনের আগে, বেশির ভাগ ব্যাংকেরই বাড়তি বিনিয়োগ ছিল। এ কারণে বাড়তি বিনিয়োগ সমন্বয়ের জন্য ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হয়।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ওই সময় থেকেই ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ নিয়ে নানাসমস্যায় ভুগে আসছে। সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছে বিনিয়োগের সর্বশেষ সীমা নিয়ে।
কারণ, ব্যাংকগুলোর যে পরিমাণ শেয়ার ধারণ করে তা নির্ধারণ হয় শেয়ারের বাজার মূল্যের ভিত্তিতে। যেমন, একটি ব্যাংক তার মোট মূলধন রয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। এর ২৫ শতাংশ হিসাবে ১২৫ কোটি টাকার শেয়ার ধারণ করতে পারবে। ওই ব্যাংকটি এ হিসাবে ১২৫ কোটি টাকার শেয়ার কিনলো।
কিন্তু একদিন পর ধারণকৃত শেয়ারের মূল্য বেড়ে ১৫০ কোটি টাকা হলো। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার চেয়ে শেয়ারের মূল্য ২৫ কোটি বেড়ে গেলো।
এখন ব্যাংককে আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে দিনের মধ্যেই ২৫ কোটি টাকার বাড়তি শেয়ার বিক্রি করতে হবে। কিন্তু একটি ব্যাংক ইচ্ছে করলেই ওই দিনে শেয়ার বিক্রি করতে পারবে না।
এ জন্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) নীতিমালা মেনেই শেয়ার বিক্রি করতে হবে।
এ কারণে ওই দিনে শেয়ার বিক্রি করতে না পারলে ব্যাংক কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন হবে। আর এ জন্য জরিমানা গুনতে হবে আরেক নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।
আইনের এ ফাঁদে পড়ে নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংককে গত ৫ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জরিমানা গুনতে হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই দিন নতুন প্রজন্মের ওই ব্যাংকটিকে ২৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। আর এ জরিমানার অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়েছে তিন কার্যদিবসের মধ্যে।
সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বাজারে মোট শেয়ার ধারণ ছিল ২৪ শতাংশ।
কিন্তু এর দুই দিনের মধ্যে বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ওই ব্যাংকের শেয়ারের ধারণ হয় তার মোট মূলধনের ২৭ শতাংশ।
ব্যাংকটি দিনে দিনে শেয়ার বিক্রি করতে পারেনি। আর সীমার অতিরিক্ত শেয়ার ধারণ চলে যাওয়ায় ব্যাংকটিকে জরিমানা গুনতে হয়।
এমনি অপরাধে ২০১৭ সালে ২০ লাখ টাকা থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৭টি ব্যাংককে জরিমানা গুনতে হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বাজারমূল্যের ভিত্তিতে শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ করায় তারা এখন উভয় সঙ্কটে পড়ে গেছে। সবসময় তারা ভয়ে তটস্থ থাকেন।
সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকেন কখন তাদের শেয়ার ধারণ নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত হয়ে যায়। একদিকে এ আইন পরিপালন করতে গিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে শেয়ার বিক্রি করতে হচ্ছে।
এতে টেকসই পুঁজিবাজার সৃষ্টিতে ব্যাহত হচ্ছে। কারণ, কোনো ব্যাংক একসাথে বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করলে পুঁজিবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
অপর দিকে, বাধ্যতামূলকভাবে শেয়ার বিক্রি না করলে আইনের লঙ্ঘনের কারণে জরিমানা গুনতে হচ্ছে।
বিষয়টি আমলে নিয়ে বিদ্যমান সমস্যা উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও এসইসির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে ভুক্তভোগী ব্যাংকাররা মনে করেন।
এইচএন