দেশে মোট রেলক্রসিংয়ের ৮২ ভাগই অরক্ষিত। রেল দুর্ঘটনার ৮৩ শতাংশরই প্রাণ যাচ্ছে ঝুঁকিপূণ এসব ক্রসিংয়ে। মরণফাঁদ এসব রেলক্রসিংয়ে প্রাণহানি ঘটলেও রেল কর্তৃপক্ষ দায় নিতে চায় না। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গত ৭ মাসে রেলক্রসিংয়ে ৩৫ দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে গত ৭ বছরে রেলক্রসিংয়ে ২১৩ জন নিহত হয়েছেন বলে বেসরকারি একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত হয়েছেন। গত ১ জুলাই দুপুুরের মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন পাঁচজন। এ ঘটনার চারদিন আগে গাজীপুরের শ্রীপুরে ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া শ্রমিক বহনকারী একটি বাসের পাঁচজন নিহত হয়। দু’টি ঘটনায়ই ঘটেছে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে। সারাদেশে এভাবে লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত থাকায় অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। গেটম্যান না থাকায় বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার এবং অটো রিকরশা উঠে যাচ্ছে লেভেল ক্রসিংয়ে। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা। অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংগুলো যেনো মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন পরপরই এভাবে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ।
তথ্যমতে-দেশে মোট রেলক্রসিংয়ের ৮২ ভাগই অরক্ষিত। রেল দুর্ঘটনার ৮৩ শতাংশরই প্রাণ যাচ্ছে ঝুঁকিপূণ এসব ক্রসিংয়ে। মরণফাঁদ এসব রেলক্রসিংয়ে প্রাণহানি ঘটলেও রেল কর্তৃপক্ষ দায় নিতে চায় না। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গত ৭ মাসে রেলক্রসিংয়ে ৩৫ দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে গত ৭ বছরে রেলক্রসিংয়ে ২১৩ জন নিহত হয়েছেন বলে বেসরকারি একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। রেলওয়ের তথ্য মতে, সারা দেশে তিন হাজার ৩৯৮টি ক্রসিংয়ের মধ্যে এক হাজার ৩৬১টি অবৈধ। আর অরক্ষিত দুই হাজার ৫৪টি। গেটম্যান নেই ৬৩২টি ক্রসিংয়ে। রেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ৮৯ শতাংশই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে।
এছাড়া এক হাজার ৪৬৪টি বৈধ লেভের ক্রসিংয়ের মধ্যে ৯০৪টিতেই কোন নিরাপত্তারক্ষী নেই। রেলপথের ওপর দিয়ে কোথাও কোথাও সড়ক চলে গেছে।
জানা গেছে, দেশে এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বাস্তবায়নে নেওয়া হয় না কার্যকর পদক্ষেপ। অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন যাতে বাস্তবায়ন করা না হয় সেজন্যও চলে মোটা অঙ্কের লেনদেন। বিশ্লেষকদের মতে-কাজেই যোগ্য বক্তিদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ৯ জন, ২০১৯ সালে ২০ জন, ২০১৮ সালে ২৩ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন, ২০১৬ সালে ২২ জন, ২০১৫ সালে ১৭ জন ও ২০১৪ সালে ৩১ জন রেল ক্রসিংয়ে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গত বছর রেলক্রসিংয়ে ৩৩টি দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ২০২১ সালে ১২৩টি রেল দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত ও ৩৯ জন আহত হয়েছে।
২০২০ সাল থেকে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশের রেলক্রসিংসমূহে ১১৬টি দুর্ঘটনায় ২১৯ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে চলতি বছরই রেলক্রসিংয়ে ৩৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৭৪ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গত ৩০ জুলাই রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে। বিবৃতিতে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার কিছু কারণও তুলে ধরেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে রয়েছে- অননুমোদিত ও অবৈধ বিবেচনা করে বহু রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান ও গেটবারের ব্যবস্থা না করা। বৈধ রেলক্রসিংসমূহে গেটম্যানদের দায়িত্বে অবহেলা এবং গেটম্যানের সংকট। যানবাহনের চালক ও সড়কে চলাচলকারীদের মধ্যে অসচেতনতা ও ধৈর্যের অভাব।
দুর্ঘটনায় দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া এবং রেলপথ ব্যবস্থাপনায় আইনের শাসনের অভাব। দেশের ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে ২ হাজার ৮৫৬টি রেলক্রসিং আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ। ৯৬১টি রেলক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই। দেশে ৮২ শতাংশ রেলক্রসিং অনিরাপদ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আরও জানিয়েছে, এই প্রতিবেদনে শুধুমাত্র রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে রেলট্র্যাকে বহু দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে, সেগুলো এই হিসাবে যুক্ত করা হয়নি।
প্রতিনিধিদের খবরে জানা যায়, নীলফামারি জেলায় প্রতিমাসেই মৃত্যু ঘটছে রেলক্রসিংয়ে। গত ১২মাসে ১৩জন মারা গেছে এই মরনফাঁদে। এ জেলায় ১২টি অরক্ষিত রেলক্রসিং থাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে দূর্ঘটনা। রেল আর সড়কের সংযোগস্থলকে বলা হয় লেভেল ক্রসিং। রেলওয়ের তথ্য বলছে, সারাদেশে এমন ৮২ শতাংশ ক্রসিংয়ে নেই গেটম্যান। নেই কোনো গেট কিংবা লোহার প্রতিবন্ধক। রেল পুলিশের কাছে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল দুর্ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়। এ ছয় বছরে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৭৫ জন।
এর মধ্যে ১৪৫ জনই প্রাণ হারিয়েছেন রেলক্রসিংয়ে। সারাদেশের রেলক্রসিংয়ের অর্ধেকেরই অনুমোদন নেই। বৈধ দেড় হাজার রেল ক্রসিংয়ের অর্ধেকেরই নেই গেটম্যান। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। ছয় মাসে শুধু গাজীপুরেই প্রাণ গেছে ৫০ জনের। যদিও সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়ে দায় এড়াচ্ছে রেল কৃর্তপক্ষ।
গাজীপুরের টঙ্গী থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু রেললাইনে কালিয়াকৈর, জয়দেবপুর থেকে শ্রীপুর এবং টঙ্গী থেকে কালিগঞ্জ পর্যন্ত অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ৩৫টি। সর্বশেষ গত ২৪ জুলাই গাজীপুরের শ্রীপুরে মাইজপাড়া ক্রসিংয়ে ট্রেনের সাথে শ্রমিকবাহী বাসের সংঘর্ষে মারা গেছেন চার জন।