ইবনে নূরুল হুদা : প্রতি অর্থবছরের শুরুতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে আকাশচুম্বী ও অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই সে লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয় না। সঙ্গত কারণেই এই লক্ষ্যমাত্রায় সংশোধনী আনা জরুরি হয়ে পড়ে। সংশোধিত ও পরিমার্জিত লক্ষ্যে পৌঁছা কখনো কখনো সম্ভব হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা যায়। ফলে জাতীয় উন্নয়নও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। অনেক সময় কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে না পৌঁছেই এনবিআরের কর্মকর্তাদের আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে দেখা যায়।
ইবনে নূরুল হুদা: প্রতি অর্থবছরের শুরুতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে আকাশচুম্বী ও অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই সে লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয় না। সঙ্গত কারণেই এই লক্ষ্যমাত্রায় সংশোধনী আনা জরুরি হয়ে পড়ে। সংশোধিত ও পরিমার্জিত লক্ষ্যে পৌঁছা কখনো কখনো সম্ভব হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা যায়। ফলে জাতীয় উন্নয়নও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। অনেক সময় কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে না পৌঁছেই এনবিআরের কর্মকর্তাদের আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে দেখা যায়।
অর্থবছর শেষ হওয়ার কয়েক মাস পর সেই তৃপ্তি হরিষে-বিষাদে পরিণত হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত চূড়ান্ত হিসাবে দেখা যায়, এনবিআরের দেখানো রাজস্ব সিংহভাগই অনাদায়ি রয়ে গেছে। সঙ্গত কারণেই বিষয়টি কখনোই প্রশ্নাতীত থাকেনি বরং একটা গোঁজামিলের মধ্য দিয়েই চলে আমাদের রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া। এনবিআর ও অর্থমন্ত্রণালয়ের হিসেবে বড়ধরনের ব্যবধানও লক্ষ্য করা যায়। এনবিআরের রাজস্ব আদায় নিয়ে প্রতিবছরই শত শত কোটি টাকার গড়মিল লক্ষ্য করা যায়। বিষয়টিকে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বস্তুত, বাংলাদেশের রাজস্ব নীতি সরকারের আয়-ব্যয়ের সামগ্রিক দর্শন, কৌশল ও ব্যবস্থাপনাকেন্দ্রিক হলেও এখন পর্যন্ত তা সুশৃক্সক্ষল নয়। তাই আমাদের জাতীয় অর্থনীতি মজবুতভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। সঙ্গত কারণেই আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতি অপরাপর জাতি-রাষ্ট্রের চেয়ে বেশ পশ্চাদপদ। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই দেশে উৎপাদনশীল ও কর্মসংস্থানমুখী অর্থনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে রাজস্ব নীতিকে সময়োপযোগী ও গতিশীল করার তাগিদ অনুভূত হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণেই তা বাস্তবরূপ পায়নি। ফলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি চলছে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
আসলে কার্যকর রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সরকারের অন্যতম সাংবিধানিক দায়িত্ব। ভারসাম্যপূর্ণ রাজস্ব নীতি দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় ৫ দশক অতিক্রান্ত হলেও এক্ষেত্রে আমাদের কোন উল্লেখযোগ্য অর্জন নেই। ফলে প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বরাবরই অধরাই থেকে গেছে। বাজেট বক্তৃতায় অনেক গালগল্প শোনানো হলেও বাস্তবতার সাথে তার কোন সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় না।
শুধু দেশের রাজস্ব খাত নয় বরং প্রায় পুরো অর্থনৈতিক সেক্টরই চলছে অনেকটা জোরাতালি দিয়ে। আমাদের সাফল্য হয়ে পড়েছে অনেকটা প্রচার সর্বস্ব ও বাস্তবতাবিবর্জিত। সম্প্রতি আমাদের জিডিপি নিয়ে এভাবেই হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’(সিডিপি)। ‘মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এখন একটি রাজনৈতিক সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এক ধরনের মোহ সৃষ্টি হয়েছে। প্রবৃদ্ধির তথ্যকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে’-সম্প্রতি এভাবেই প্রবৃদ্ধির ব্যাখ্যা করা হয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে। যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে নৈরাজ্যের কথায় স্মরণ করে দেয়।
পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত বিদায়ী অর্থবছরের জিডিপির সাময়িক হিসাব নিয়ে সম্প্রতি ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলন করেছে সিপিডি। সম্মেলনে বলা হয়, ‘প্রবৃদ্ধির হিসাব অতিরঞ্জিত করে লাভ নেই। এটা নীতিনির্ধারণে সহায়তা করবে না’। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান বিবিএসের স্বাধীনতা দিন দিন খর্ব করা হচ্ছে। ফলে তথ্যপ্রাপ্তির সাংবিধানিক অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে কোন কিছুতেই স্বচ্ছতা থাকছে না। আর আমাদের দেশের অর্থনীতি সে বৃত্তেই আটকা পড়েছে। ফলে ছন্দ হারাতে বসেছে জাতীয় অর্থনীতি।
বিগত অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবৃদ্ধির এই হিসাব মোটেই বাস্তবসম্মত নয় বরং এর মধ্যে বড় ধরনের তথ্যগত বিভ্রাট রয়েছে। বিবিএস-এর বক্তব্য হচ্ছে, করোনার মধ্যেও ব্যক্তি বিনিয়োগ গতবারের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে, যা নীতিনির্ধারকদের ভুল বার্তা দিচ্ছে। কারণ এই তথ্যের মধ্যে বড় ধরনের গরমিল পরিলক্ষিত হচ্ছে। আসলে এত বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হলে তো ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা রাখার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজের প্রয়োজন হতো না। বিষয়টিতে যে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য রয়েছে তা খুবই স্পষ্ট। কিন্তু ভুল তথ্য দিয়ে জনতুষ্টি করা সম্ভব হলেও এতে দেশ ও জাতির কোন কল্যাণ করা সম্ভব হয় না বরং নতুন সঙ্কটের জন্ম দেয়।
বস্তুত, এক অশুভ বৃত্তেই আটকা পড়েছে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। এ প্রবণতা থেকে মুক্ত থাকেনি আমাদের রাজস্ব খাতও। প্রতিবারে জাতীয় বাজেটে উচ্চাভিলাষী ও বাস্তবতাবিবর্জিত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হলেও স্বাধীনতার পর কোন বাজেটই রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার কর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই আয় আসবে মূলত আয়কর, ভ্যাট এবং আমদানি ও রফতানি শুল্ক থেকে-এমনটিই বলা হয়েছে বাজেটে। এনবিআর-বহির্ভূত কর ব্যবস্থা থেকে ১৫ হাজার কোটি এবং করবহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরিত হবে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতি ব্যাংক ঋণ, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের অর্থে মেটানো হবে। যা অর্থনীতিবিদরা কোন ভাবেই বাস্তবসম্মত মনে করছেন না।
প্রতিবারের মত চলতি অর্থবছরেও যে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য মাত্রা অর্জিত হবে না তা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অর্থবছরের প্রথম মাসেই রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে যথারীতি। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ১৯ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। কিন্তু এই সময় প্রকৃতপক্ষে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে যা ৭ হাজার ৪৪ কোটি টাকা কম। শতকরা হিসেবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে ৩৬ শতাংশ। আর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আদায় কম হয়েছে ২২ শতাংশ। এনবিআর ও অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এনবিআরের প্রাথমিক হিসেবে জুলাই মাসে রাজস্ব আদায়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর খাত। এ খাতে জুলাই মাসে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ছিল সাত হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র তিন হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এরপর ব্যর্থতার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আয়কর খাত। এই খাতের জন্য জুলাই মাসে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট দেয়া ছিল চার হাজার ২১৯ কোটি টাকা। কিন্তু আদায় করা সম্ভব হয়েছে তিন হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। একইভাবে আমদানি শুল্কের টার্গেট ছিল সাত হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে চার হাজার ৯২৮ কোটি টাকা।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এনবিআর খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা রয়েছে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়, মুনাফা ও মূলধনের ওপর কর আদায় করতে হবে এক লাখ ৩ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। ভ্যাট থেকে আদায় করতে হবে এক লাখ ২৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। সম্পূরক শুল্ক থেকে ৫৭ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা, আমদানি শুল্ক ৩৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা এবং আবগারি শুল্ক থেকে আদায় করতে হবে তিন হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা।
বিগত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৫শ কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এই রাজস্ব পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ২.৪৫ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা হলো তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এতে এবারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ৫১ শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে। এর বিপরীতে প্রথম মাসে আগের বছরের একই সাময়ের তুলনায় কম রাজস্ব আদায় হয়েছে ২২ শতাংশ। তাই চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে বাজেট বাস্তবায়নে বড় ধরনের জটিলতা দেখা দেবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগের বছরের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির কারণে এবারের যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না। এতে সরকারের বাজেটের ব্যয় সংকুলান করতে হিমসিম খেতে হবে। ইতোমধ্যেই মধ্যে জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমতে শুরু করেছে। ফলে সরকারের বাজেটের রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা সামাল দিতে হলে ব্যাংক খাত থেকে আরো বেশি হারে ঋণ নিতে হবে। এবার ব্যাংক খাত থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা নেবার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। তবে গতবার ৪৭ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণ ৮২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এবার এই অঙ্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে প্রথম মাসেই ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র থেকে জানা গেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বেসরকারি খাতের জন্য ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে বলে ব্যবসায়ী নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন করা করোনাকালীন এই সময়ে মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। এর আগে শুধু একবার রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ। এবার খুব বেশি হলে এই প্রবৃদ্ধি সাড়ে ১২ শতাংশ হতে পারে।
আমাদের অর্থনীতিতে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন যে সম্ভব নয় বিদায়ী অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের দিক তাকলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এনবিআরকে তিন লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আদায় ব্যর্থতার কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২৫ হাজার কমিয়ে সংশোধিত লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় তিন লাখ ৫শ কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে তাও অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এই সময় রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৮২ হাজার কোটি টাকা। যা সত্যিতই উদ্বেগজনক।
বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে উচ্চ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও রাজস্ব আয়ে সরকারের উচ্চাভিলাষী আকাক্সক্ষা সময়োপযোগী নয় বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এর পক্ষে। এতে বলা হয়, নতুন অর্থবছরের বাজেটে কিছু কিছু জায়গায় অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যা বাস্তবায়ন কোনভাবেই সম্ভব নয়। অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রাগুলো হলো জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ক্ষেত্রে বড় ধরনের অসামঞ্জস্যতা রয়ে গেছে। আর তা সামাল দেয়া মোটেই সহজসাধ্য হবে না। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রাকে কেউই বাস্তবসম্মত মনে করছেন না। কারণ, শুধু বাংলাদেশ নয় বরং সারাবিশ্বেই এখন নেতিবাক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তাই অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ও রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবতাবিবর্জিত ও অযৌক্তিক।
২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা বাজেট জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। গৃহীত বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয়বাবদ খরচ ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভুত কর থেকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর ব্যতীত রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ৬ শতাংশ। এ হার গত বাজেটে ছিল ৫ শতাংশ।
যে দেশের রাজস্ব ব্যবস্থা যত গতিশীল সে দেশের অর্থনীতিও ততই মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমাদের দেশের রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে কোন ধারাবাহিকতা নেই। সরকার প্রতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা দেয় তা কখনোই বাস্তবতা পায় না। শুধু জনতুষ্টির জন্য যে প্রবৃদ্ধির হিসাব দেয়া হয় তাও বাস্তবতাবিবর্জিত। ফলে কল্পিত রাজস্ব আদায় ও ভৌতিক প্রবৃদ্ধি আমাদের জাতীয় জীবনে কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলে না। তাই দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে সময়োপযোগী ও গতিশীল করে ঢেলে সাজানো সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। আর প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য গ্রহণ করতে হবে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত। অন্যথায় রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা অধরাই থেকে যাবে; অর্থনীতিতেও আসবে না কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি।
লেখক: ইবনে নূরুল হুদা
[email protected]
(বি. দ্র. মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব। টাইমনিউজবিডির সম্পাদকীয় নীতিমালার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই)
এমবি