অবশেষে ব্যাংকেই সেঞ্চুরির পথে হাটছে ডলার!
Share on:
মার্কিন ডলার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় এবার আন্তঃব্যাংক লেনদেনেই সেঞ্চুরির দ্বারপ্রান্তে। বুধবার আমদানি দায় মেটাতে ব্যাংকগুলো নগদে সর্বোচ্চ ৯৮ টাকা দরে ডলার কিনেছে। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দর হলো ৮৭ টাকা ৬০ পয়সা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আন্তঃব্যাংকে সর্বোচ্চ ৮৭ টাকা ৬০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করতে হবে। কিন্তু এ দরে আন্তঃব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই আমাদের জরুরি আমদানি দায় মেটাতে বেশি দরে নগদে ডলার কিনতে হচ্ছে। এতে আমাদের সামগ্রিক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বেশি দরে ডলার কিনতে গিয়ে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতিতে যার প্রভাব পড়বে।
ব্যাংকগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বুধবার ( ১৮ মে ) বেসরকারি ইস্টার্ন ও প্রাইম ব্যাংক থেকে ১ ডলার পেতে ৯৮ টাকা খরচ করতে হয়েছে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে। আন্তঃব্যাংক ডলার লেনেদেনে এটি ছিল সর্বোচ্চ দর। এদিন রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে ১ ডলার কিনতে অন্য ব্যাংকগুলোকে ব্যয় করতে হয়েছে ৯৪ টাকা।
অগ্রণী ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে ৯২ টাকা ৫০ পয়সায়। সোনালী ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে লেগেছে ৯২ টাকা ৪৫ পয়সা। তবে খোলা বাজারে গতকাল ডলারের দাম বাড়েনি, বরং গতকাল ১০০ টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ডলারের দর।
কিছু ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, গতকাল একদিকে ডলারের যেমন কোনো ক্রেতা ছিল না, তেমনি ছিল না বিক্রেতাও। এ কারণে খোলাবাজারে মঙ্গলবারের ডলারের মূল্য নিয়ে হইচই ছিল না।
বুধবার সংবাদ মাধ্যমকে ট্রেজারি ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব থাকা নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ডিএমডি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অহেতুক ডলারের দর ধরে রেখেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রির জন্য যে দর বেঁধে দিয়েছে তা কেউ মানছে না। আন্তঃব্যাংকে এই দরে কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কমপক্ষে ৮-১০ টাকা বেশি দরে ডলার কিনে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, কিছু ব্যাংক রফতানিকারকদের কাছ থেকে বেশি দরে ডলার কিনছে।
আবার ওই ডলার বেশি দরে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করছে। এটি বেশ কিছু দিন ধরেই চলছে। কিন্তু এখন তা তীব্র আকারে দেখা দিয়েছে। তিনি জানান, ডলারের সরবরাহ না বাড়া পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম বলেন, ডলারের দাম চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। ২ বছরের করোনা প্রাদুর্ভাব কাটার পর আবারো বিনিয়োগ ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। এর ফলে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। একই সাথে করোনার কারণে গত দুই বছরে পণ্য আমদানির দায় পরিশোধ না করে বাকি রাখা (ডেফার্ড) রাখা হয়েছে।
অন্য দিকে করোনার পর মানুষ ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশ ভ্রমণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে ডলারের চাহিদা একসাথে ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত হারে ডলারের সরবরাহ বাড়েনি। এ কারণেই ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানাভাবে চেষ্টা করছে মার্কেট নিয়ন্ত্রণে রাখতে।
এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ৫ বিলিয়নের ওপরে ডলার সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। কোনো ব্যাংকের এলসির দায় মেটাতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করছে।
ব্যাংক কর্তারা জানিয়েছেন, ডলারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকায় কয়েক মাস ধরেই মার্কেটে ডলার সঙ্কট ছিল। প্রায় প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একসময় ঢালাওভাবে ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করত। কিন্তু এখন তা আর করা হচ্ছে না।
শুধু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি দায় পরিশোধ করতে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, চাহিদার চেয়ে অনেক কম ডলার সরবরাহ করায় ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে বেশি দরে মার্কেট থেকে ডলার কিনছে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে কিছু ব্যাংক।
তারা প্রতিদিনই নগদ ডলারের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। যা গতকাল সর্বোচ্চ ৯৮ টাকা উঠে যায়। এ ধারা অব্যাহত থাকলে কয়েক দিনের মধ্যেই তা ১০০ টাকা ছেড়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা।
বাংলাদেশ কেন্দ্রিয় ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। গত জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত পাঁচ মাসে সাতবার ডলারের দাম বাড়ানো হয়। এর মধ্যে জানুয়ারির প্রথম দিকে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করা হয়।
২৩ মার্চ ২০ পয়সা, ২৭ এপ্রিল ২৫ পয়সা, ৯ মে ২৫ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়। ১৬ মে এক লাফে ৮০ পয়সা বাড়িয়ে সাড়ে ৮৭ টাকা করা হয়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার আবার ১০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৭ টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম বাড়ার সাথে সাথে ব্যাংকগুলোও এর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বাতিল : এ দিকে ডলারের সঙ্কটের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে বিদেশ ভ্রমণের জন্য জারি করা সব আদেশ বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া নতুন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে ও আংশিক অর্থায়নে বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ আদেশের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ, শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, সেমিনার ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ বন্ধ হয়ে গেল। তবে নিজস্ব অর্থায়নে চিকিৎসা ও হজ পালনের জন্য বিদেশে ভ্রমণ করা যাবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে।
গত সোমবার ( ১৬ মে ) সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের নির্দেশ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।
এইচএন