tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
জাতীয় প্রকাশনার সময়: ১৭ জানুয়ারী ২০২৪, ১০:২০ এএম

রাজধানীজুড়ে গ্যাসের জন্য হাহাকার, কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা


image-256706-1705464979

গ্যাস সংকট, রাজধানীবাসীর পুরনো সমস্যাগুলোর একটি। শীত এলে প্রতি বছরই এই সংকট ভোগান্তিতে রূপ নেয়। তার ওপর চাহিদার তুলনায় এবার গ্যাসের সরবরাহও অনেক কম, যার ফলে ভোগান্তির মাত্রা এ বছর আরও বেশি।


রাজধানীর বেশির ভাগ আবাসিক এলাকায় এখন গ্যাসের অভাবে চুলা প্রায় জ্বলছেই না। সিএনজি স্টেশনগুলোতেও মিলছে না পর্যাপ্ত গ্যাস। স্টেশনগুলোর বাইরে গাড়ির দীর্ঘ লাইন। গ্যাসের অভাবে ধুঁকছে শিল্পকারখানাগুলোও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম গ্যাস সরবরাহ করছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। সেইসঙ্গে শীতে ঠান্ডার তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাইপলাইনে গ্যাস জমে সংকট আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

দেশে বর্তমানে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৪২০ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলা সরবরাহ করছে ২৫৫ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি ১৬৫ কোটি ঘনফুট। আবার দেশি গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকেও দিন দিন উৎপাদন কমছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ২০২৬ সালের মধ্যে দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কাজ চলছে। তবে সম্প্রতি যে সংকট চলছে সেটি কিছুদিনের মধ্যে সমাধান হবে। যদিও খুব তাড়াতাড়ি সংকট সমাধানের কোনো আশা দেখাতে পারেননি তিনি।

গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করা গ্যাস সরবরাহে দেশে দুটি রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) আছে। গত নভেম্বর মাসে একটি ইউনিট সংস্কারের জন্য পাঠানো হয়। এ কারণে গ্যাসের সংকট বেড়েছে। সংস্কার শেষ হওয়ার দু-একদিনের মধ্যেই ইউনিটটি গ্যাস সরবরাহ শুরু করবে। কিন্তু একইসঙ্গে অন্য একটি এফএসআরইউ সংস্কার কাজের জন্য পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। আগামী মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই ইউনিটটির সংস্কারকাজ চলবে। এরপর আগামী রমজান ও বোরো সেচ মৌসুমকে সামনে রেখে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

দুটি ইউনিট চালু থাকলে প্রতিদিন প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হয়। বর্তমানে একটি ইউনিট প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে। অর্থাৎ দ্বিতীয় ইউনিটটি চালু হলেও গ্যাস সংকট থেকেই যাচ্ছে।

পেট্রোবাংলাসহ জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গ্যাস সংকটের কারণে ২০২০ সালের এপ্রিলের পর এবারই দেশে গ্যাসের সরবরাহ সর্বনিম্ন। এই সরবরাহ ২০২১ সালের শেষ ছয় মাসের গড় সরবরাহ থেকেও কম। সে সময় ডলারের অভাবে স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ ছিল। এলএনজির দামও তখন ছিল আকাশছোঁয়া।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, দেশীয় উৎপাদন কমে যাওয়া বর্তমান গ্যাস সংকটের একটা বড় কারণ। পাশাপাশি এলএনজি আমদানির পরিমাণও কমেছে। খুব শিগগিরই এই সংকট থেকে উত্তরণের পথও দেখতে পাচ্ছেন না তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে গ্যাস সরবরাহের কিছুটা উন্নতি হলেও, তখন গ্যাসের চাহিদা আরও বাড়বে। ফলে ধৈর্য ধরা ছাড়া কোনো সমাধান দেখাতে পারছেন না তারা।

এদিকে আবাসিকে গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করছে তিতাস কর্তৃপক্ষ। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন ডিভিশন) প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া জানান, একে শীত, অন্যদিকে গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় এ সংকট তৈরি হয়েছে।

চলতি মাসের শুরু থেকে এই সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, শেখের টেক, পশ্চিম ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, মধুবাজার, ডেমরা, পূর্ব দোগাইর, হাজীনগর, কোলাটিয়া, পূর্ব শেওড়াপাড়া, মিরপুর, শ্যামলী, পল্লবী, বনশ্রী, গেণ্ডারিয়া, নবাবগঞ্জ, নারিন্দা, মোহাম্মদপুর ও ভাষানটেকসহ পুরান ঢাকার বেশিরভাগ এলাকা ঘুরে গ্যাসের সংকট দেখা গেছে।

শেখের টেক এলাকার জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, চলমান গ্যাস সংকটে ভোররাত ৩টা পর্যন্ত তাকে রান্না করতে হয়। সকাল ৭টার পর তাদের গ্যাস থাকে না। রাত ১০টার পর গ্যাসের চাপ কিছুটা বাড়ে। তবে ভোররাতের দিকে গ্যাসের চাপ বেশি থাকে। তিতাসের এ গ্রাহক বলেন, আমরা প্রতি মাসে বিল দিচ্ছি, কিন্তু পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছি না। তিতাসের সংযোগ থাকলেও এলপিজি ব্যবহার করতে হচ্ছে। একেকজন গ্রাহক বাধ্য হয়ে দুবার বিল দিচ্ছি। যাদের পক্ষে এলপিজির ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়, তাদের ভোররাত তিনটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তখন চুলায় গ্যাসের কিছুটা চাপ থাকে।

ভাষানটেক বিআরপি এলাকার প্রায় দুই হাজার পরিবারের অনেকেই কাঠ-লাকড়ি পুড়িয়ে রান্না করছেন। আবার যাদের আয় ভালো, তারা এলপিজি ব্যবহার করেছেন। কারণ তাদের এলাকায় গ্যাস থাকে রাত দেড়টা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত। বদরুল হায়দার নামে আজিমপুর এলাকার এক বাসিন্দা জানান, আগে প্রতিদিন দুপুরের খাবার খেতে বাসায় আসতেন। এখন তাকে বাইরে খেতে হচ্ছে। কারণ গ্যাসের অভাবে তার স্ত্রী দিনের বেলা রান্না করতে পারছেন না।

গ্যাস সংকটের কারণে অনেক শিল্প-কারখানা দিনে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। গাজীপুর, সাভার, কোনাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশের শিল্পাঞ্চলে চলছে এই সংকট। শিল্পমালিকরা বলছেন, একদিকে ডলার সংকট, অন্যদিকে গ্যাস সংকট। এমন চলতে থাকলে এই সেক্টরে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে। তারা বলেন, বেশ কিছুদিন হলো গ্যাসের সংকট তেমন ছিল না। কিন্তু চলতি মাসের শুরু থেকে সংকট দেখা দিয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে এই সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। বেশিরভাগ এলাকায় দিনের বেলায় কল-কারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

টোটাল ফ্যাশন নামে নারায়ণগঞ্জের একটি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, গ্যাস সংকটে তাদের উৎপাদন তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।

দেশের অন্যতম ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম-এর এক কর্মকর্তা বলেন, গ্যাস সংকটে তাদের জ্বালানি চাহিদার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডিজেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে তাদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে।

সিরামিক শিল্পের অন্যতম প্রধান উপকরণই গ্যাস। ফলে চলমান সংকটে এই ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতিও হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ফার সিরামিকস লিমিটেডের এক কর্মকর্তা জানান, তাদের কারখানায় গ্যাসের চাপ কমপক্ষে ১০ পিএসআই (চাপের একক) থাকতে হয়। কিন্তু দিনের বেলা বেশিরভাগ সময়ই চাপ থাকে দুই থেকে চার পিএসআই। ফলে পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে।

সার্বিক বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেছেন, স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। তবে আমরা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করছি। আর তাৎক্ষণিক এই গ্যাস সংকট মোকাবিলায় এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে, বর্তমানে ডলার মজুদের যে অবস্থা, এমন পরিস্থিতিতে সরকারের আমদানি বাড়ানোর সম্ভাবনা কম।

এনএইচ