একযোগে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ, যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
Share on:
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর স্থানীয় সরকার আইন সংশোধন করে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে তাদের স্থানে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে তাদের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। তারা কী অতিরিক্ত কাজ সঠিকভাবে করতে পারবেন; এনিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। এদিকে ঢালাওভাবে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের ঘটনায় মিশ্রপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। খবর ডয়চে ভেলের।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার বিভাগ পৃথক প্রজ্ঞাপনে সোমবার ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়র, ৬০টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সারা দেশের সব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের এই চার স্তরে সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮৭৬ জন জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করা হলো। অপসারণ করা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের জায়গায় বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
ার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সিটি করপোরেশনে মেয়রদের অপসারণ করা হলেও কাউন্সিলরদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রশাসক থাকলে কাউন্সিলররা দায়িত্ব পালন করবেন কি করবে না, সেটা এখন তাদের ব্যাপার। মূল কথা হচ্ছে, মেয়র ও চেয়ারম্যানের জায়গায় প্রশাসক দায়িত্ব পালন করবেন। আমরা ধারাবাহিকভাবে কাজ করব। এখানে মার মার কাট কাটের কোনো বিষয় নেই। এটি সমগ্র স্থানীয় সরকারকে পরিচ্ছন্ন করার একটি প্রচেষ্টা।
একসঙ্গে এত জনপ্রতিনিধি অপসারণের কারণে নাগরিকসেবা বিঘ্নিত হতে পারে কিনা জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এর বিকল্প কী ছিল? এসব জনপ্রতিনিধি তো অফিসে যাচ্ছিলেন না। তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমার মনে হয় ঠিকই আছে।
বিগত সরকারের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে একমত ছিলেন না এমন অনেকেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদেরও এখন বাদ দেওয়া হয়েছে। তারা বলছেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিলে নাগরিক সেবা কি আরও ভালোভাবে দেওয়া সম্ভব ছিল না? এ প্রসঙ্গে মজুমদার বলেন, এটা হলে তো ভালোই হতো। কিন্তু এটা বের করবে কিভাবে? এটা বের করা বিশাল চ্যালেঞ্জ।
আগে সব ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হতো। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। শুরুর দিকে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। পরে বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন শুরু করে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীন কোনো নির্বাচনে দলটি অংশ নেয়নি। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ এ বছর অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী দেয়নি। সেই নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী জয়ী হন। সিটি করপোরেশনের ভোটেও একই চিত্র দেখা গেছে।
যেভাবে একযোগে এত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করা হলো এর কি বিকল্প কোনো পথ ছিল কিনা জানতে চাইলে সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, বিকল্প হয়ত ছিল না। কিন্তু সমস্যা হলো যেসব সরকারি কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো, তাদের তো অনেক কাজ। তাদের মূল কাজের অতিরিক্ত হিসেবে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন তারা মূল কাজ সামলাবেন, নাকি অতিরিক্ত কাজ করবেন? দ্রুত এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে। তা না হলে স্থানীয় সরকারের নাগরিকসেবা দারুণভাবে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
গত শুক্রবার ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ ও ‘উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। পরে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। ওই সংশোধনীর ফলে বিশেষ পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করলে সরকার জনস্বার্থে কোনো সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরকে অপসারণ করতে পারবে। একইভাবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণ করতে পারবে। একই সঙ্গে এগুলোয় প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে সরকার।
ঢালাওভাবে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের পক্ষে নন বিগত সরকারের রাজনৈতিক আদর্শের বাইরে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন এমন জনপ্রতিনিধিরা। মাগুরার শালিখা উপজেলার শালিখা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হোসাইন সিকদার বলেন, অধিকাংশ জায়গায় সঠিকভাবে ভোট না হলেও দু-একটি জায়গায় স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদের তো বিগত সরকার চেষ্টা করেও ফেল করাতে পারেনি। ফলে আমরা যারা সত্যিকারের ভোটে জনগণের রায় নিয়ে নির্বাচিত হয়েছি, তাদের ব্যাপারে পৃথক সিদ্ধান্ত থাকার দরকার ছিল। সরকারি কর্মকর্তারা কি এলাকার কাউকে চেনেন? তারা তো বাইরে থেকে এসেছেন। ফলে সরকারের উচিত হবে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যিনি অপেক্ষাকৃত সৎ ও ভালো মানুষ- তাদের দায়িত্বে নিয়ে আসা। একটা ইউনিয়নে তো অনেকগুলো মেম্বার থাকেন। তাদের সবাই কিন্তু অসৎ বা খারাপ মানুষ না। তাদের মধ্যে ভালো মানুষকে খুঁজে দায়িত্বে আনতে হবে।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, সরকার বরং যেটা করেছে সেটাই প্রয়োজন ছিল। স্থানীয় সরকারের সেবা সচল রাখতেই সরকারের এই উদ্যোগ। অধিকাংশ চেয়ারম্যান, মেয়ররা তো পালিয়ে গেছেন। এখন একজন মানুষের জন্মনিবন্ধন সনদ দরকার, সে যদি এটা না পায় তাহলে তার কোনো কাজই হবে না। সেখানে ওই জনপ্রতিনিধির হয়ত স্বাক্ষর প্রয়োজন। তিনি তো নেই, এটা কে দেবে? সরকার প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ায় তিনি এখন সেই স্বাক্ষরটি দিতে পারবেন।
একসঙ্গে সবাইকে বাদ না দিয়ে পর্যায়ক্রমে করলে ভালো হতো কিনা জানতে চাইলে খান বলেন, পর্যায়ক্রমে তো করার সুযোগ নেই। পঞ্চগড়ে যে অবস্থা, সাভারেও সেই অবস্থা, আবার টেকনাফেও একই অবস্থা। ফলে কোনো এলাকা অগ্রাধিকার দেবেন? সব জায়গাতেই তো একই চিত্র। তাই আমি মনে করি, সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এনএইচ