tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশনার সময়: ২৪ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৫১ এএম

দ্রব্য মুল্যের উর্ধ্বগতিতে পুষ্টিবঞ্চিত সাধারণ মানুষ


food

নাজমুল হাসান : সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েই যাচ্ছে, যা ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। পণ্যের ব্যয় সংকুলান করতে না পেরে খাদ্য তালিকায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এটি করতে গিয়ে আমিষসমৃদ্ধ পণ্যসহ পুষ্টিকর খাবার কেনা কমিয়ে দিতে হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষদের। এতে করে দেখা গেছে মানুষের পুষ্টির ঘাটতি আরও বেড়ে চলেছে। বড় খেসারত দিতে হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের। পুষ্টিকর খাবার না পেয়ে অনেক শিশু ও প্রসূতি মা পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন।


স্বল্প আয় বা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে পুষ্টি নয়, টিকে থাকাই এখন যেন অনেকের মূল লক্ষ্য।

এবিষয়ে বাবুল হৃদয় নামে একজনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, যেখানে স্বাভাবিক খাবারেই কিনতে পারিনা সেখানে পুষ্টিকর খাবারের তালিকার মাছ, মাংস, ডিমসহ ইত্যাদি পণ্য কেনা তো এখন স্বপ্নের মতো লাগে। উর্ধ্বগতির বাজারে স্ত্রী সন্তান নিয়ে বর্তমান পুষ্টিহীনতায় ভুগছি।

আব্দুস সাত্তার শেখ লিমন নামে একজন সচেতন ব্যক্তি সাথে কথা হয়। এসময় তিনি বলেন, এই উর্ধ্বগতির বাজারেও একটু সস্থির আভাস দেখা দিয়েছে শীতকালীন সবজির বাজারে। গতকয়েকদিন আগে ডিমের দাম কমেছে এতে করে মাছ, মাংস কিনতে না পারলেও অন্তত ডিম কিনে পুষ্টির চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছি।

কথা হয় কমার্শিয়াল নাহিদ হাসান নামে একজনের সাথে। তিনি বলেন, ‘করোনাকালে চাকরি হারানোর পর অনেক কষ্ট করেছি। ২০২২ সালে আরেকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছি। কিন্তু আগের মতো আর সামলানো যাচ্ছে না। সবকিছু যেন বেসামাল, নিয়ন্ত্রণহীন। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া এক সন্তানের স্কুল খরচা, আরেক শিশুসন্তানের অসুস্থতা, নিত্য সব পণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে আয়-ব্যয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। বাসা বদলে মিরপুরের ছোট্ট একটি ঘর নিয়ে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছি।’

তিনি বলেন, করোনাকালে যেমন চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়েছিলাম, তেমনি এখন খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট করছি। খারাপ লাগে দুই বাচ্চার জন্য। টিকে থাকার জন্য আগের মতো দুধ, কলা, ডিম, বাদাম কিংবা ওটস ওদের খাওয়াতে পারি না। খরচের হিসাবে কাটছাঁটে ওদের (সন্তান) পুষ্টিতে টান পড়ছে। বাস্তবতা হলো, খাদ্যপণ্য ছাড়া আর কাটছাঁটের জায়গাও নেই।

পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার শিশুর মস্তিষ্ক সক্রিয় ও সতেজ রাখে। মস্তিষ্ক সক্রিয় ও সতেজ থাকলে শিশুর মেধা ও বুদ্ধির বিকাশ দ্রুত হয়। শিশুদের বেড়ে ওঠায় যেসব খাবার অনেক বেশি ভূমিকা রাখে সেগুলো পরিমিত পরিমাণে খাওয়ানোর পরামর্শ জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডায়টেশিয়ান আয়েশা সিদ্দিকার।

তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের পাকস্থলী ছোট। তাই তাদের পেট অল্পতেই ভরে যায়। এক্ষেত্রে অল্প পরিমাণ করে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। পনিরে আছে প্রচুর আমিষ ও ক্যালসিয়াম, যা সুস্থ হাড় ও দাঁতের জন্য আবশ্যক। একই সঙ্গে দাঁতের ক্ষয়রোধ করে। শিশুর মস্তিষ্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির উপযুক্ত বিকাশে তাকে ছয় মাস বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত।’

ডিমে রয়েছে প্রচুর আয়রন। যা লোহিত কণিকা তৈরি করে রক্তের উপাদানে সঠিক মাত্রা বজায় রাখে। এটি মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়। যা চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধিতে সহায়ক। সামুদ্রিক মাছ ও মাছের তেল মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন এগুলো খাওয়ানো উচিত। কলা এমন একটি ফল, যা তুলনামূলক সস্তা ও প্রচুর পরিমাণে বলকারক কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাযুক্ত। প্রতিদিন একটি করে কলা শিশুর পুষ্টির অনেক কিছু পূরণ করে।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের পণ্যের বাজারদর বলছে, রুই প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ৩৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫০ টাকা। যা গত সপ্তাহ এবং গত মাসেও প্রায় একই ছিল। ছোট সাইজের ইলিশের কেজি ৬০০ টাকা। এক কেজি সাইজের ইলিশ ১৩০০ টাকা। গরুর মাংসের কেজি ৭৩০-৭৫০ টাকা। তবে, বাজারে ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে ঘুরছে দাম।

টিসিবি বলছে, খাসির মাংসের কেজি এক হাজার থেকে ১১০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৬৫ থেকে ১৭৫ টাকা বলা হলেও বাজারে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি মুরগির কেজি ৫০০ টাকা বলা হলেও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

টিসিবির নিত্যপণ্যের মূলতালিকা বলছে, প্যাকেটজাত দুধ সবার জন্য নয়। বিভিন্ন ধরনের গুঁড়া দুধ (প্যাকেটজাত) ৭৮০ থেকে ৮৩০ টাকার মধ্যে। ডিম (ফার্ম) প্রতি হালি ৪২ থেকে ৪৫ টাকা। গত সপ্তাহে যা ছিল ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা। তবে, বাজারে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা হালিতে বিক্রি হচ্ছে ফার্মের ডিম।

অপুষ্টির কারণে দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৬ শতাংশ শিশু খর্বকায়। এসব শিশুর সংখ্যা ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার। তাদের উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংকের চলতি বছরের ২৩ মে প্রকাশিত ‘শিশুর অপুষ্টির মাত্রা ও প্রবণতা’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনের শুরুতে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, পুষ্টি প্রতিটি শিশুর অধিকার। পুষ্ট শিশু পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে বেড়ে উঠতে এবং উন্নতি করতে পারে। তারা স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের অধিকারী হয়, তারা শেখা ও চর্চার ক্ষেত্রে ভালো করে, তারা দারিদ্র্য থেকে দূরে থাকে। বৈশ্বিকভাবে অপুষ্টি কমে এলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন সমস্যা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে অন্তত একটি ক্ষেত্রে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি বাড়ছে। আগের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত ওজনের শিশুর সংখ্যা বাড়ছে।

বৈশ্বিক প্রতিবেদনটি বলছে, বাংলাদেশে বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম, এমন শিশুর সংখ্যা কমছে। ২০১২ সালে যা ছিল ৩৯ শতাংশ বা ৬০ লাখ ৪৬ হাজার। বর্তমানে ২৬ শতাংশ বা ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার। তবে, এ সংখ্যাকেও ‘উচ্চ হার’ বলছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংক।

প্রতিবেদনের তথ্যগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা প্রয়োজন, উল্লেখ করে পুষ্টিবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের দেশীয় পরিচালক সাইকা সিরাজ বলেন, ‘শিশু অপুষ্টির আলোচনায় প্রথমে শিশুদের উচ্চতার প্রসঙ্গ চলে আসে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। খর্বকায় শিশুদের শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। এ সমস্যা জীবনভর চলে এবং এর পরিণাম পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছায়। অপুষ্টির দ্বিগুণ বোঝা নিরসনে বহু খাতভিত্তিক পুষ্টিব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নের প্রয়োজন। স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্য বিভাগগুলোর পুষ্টি সহায়ক কার্যক্রমগুলো জোরদার করা উচিত।’

পরিবারের আয়ের সঙ্গে পুষ্টির সম্পর্ক রয়েছে, উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘আয় কমলে, অন্যদিকে ব্যয় বাড়লে প্রথমে খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট শুরু হয়। মূল্যস্ফীতির কারণে স্বল্প আয়ের পরিবার থেকে ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসসহ আমিষ জাতীয় খাদ্য উঠে যাচ্ছে। খাদ্য সংকট বা অপুষ্টির কারণে শিশুদের প্রথমে ওজন কমে। প্রসূতি মায়েরা সঠিক খাদ্য পান না। যার বড় খেসারত দিতে হয় অনাগত শিশুদের। পারিবারিক খাদ্যতালিকা থেকে যদি প্রাণীজসহ পুষ্টিকর খাদ্য বাদ যায় তাহলে ভবিষ্যতে শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বেই।’

ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী, শিশুর পুষ্টিগত চাহিদার ক্রমবর্ধমান গতির সঙ্গে তাদের প্রাপ্য খাবারের চাহিদা তাল মেলাতে ব্যর্থ হওয়ায় বৈশ্বিকভাবে পাঁচ বছরের কম বয়সী রুগ্নতার শিকার হওয়া শিশুদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ দুই কোটি ৩০ লাখ শিশু যাদের বয়স দুই বছরেরও কম, তাদের মধ্যে খর্বাকৃতির সমস্যা দ্রুত বাড়ছে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ খাদ্য সম্মেলনের আগে ইউনিসেফের প্রকাশিত ‘ফেড টু ফেইল : দ্য ক্রাইসিস অব চিলড্রেন্স ডায়েটস ইন আর্লি লাইফ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের হার, অসমতা, সংঘাত, জলবায়ু-সংক্রান্ত দুর্যোগ এবং কোভিড- ১৯ মহামারির মতো জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিশ্বে সবচেয়ে কম বয়সীদের মাঝে বিদ্যমান পুষ্টি সংকটকে প্রকট করেছে। এ ক্ষেত্রে গত ১০ বছরে খুব সামান্যই উন্নতির লক্ষণ দেখা গেছে। ইউনিসেফের ওই প্রতিবেদনে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তার প্রথমেই আছে উৎপাদন, বিতরণ এবং খুচরা পর্যায়ে বিক্রয়কে উৎসাহিত করার মাধ্যমে ফল, শাক-সবজি, ডিম, মাছ, মাংস এবং শক্তিবৃদ্ধি করে এমন খাবারসহ পুষ্টিকর খাবারের প্রাপ্যতা ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ঝুঁকির মধ্যে চলে যাচ্ছে দেশ। মূল্যস্ফীতির কারণে লাগামহীন সব পণ্য। দিশেহারা হচ্ছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। সরকারের উদ্যোগ থাকলেও তেমন ফলপ্রসূ নয়। মূল্যস্ফীতি কমানো না গেলে কষ্ট আরও বাড়বে স্বল্প আয়ের মানুষের। এর বড় প্রভাব সরাসরি পড়বে শিশুদের ওপর।

এনএইচ