আনার হত্যার ছবি প্রকাশ, বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য
Share on:
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের সঙ্গে কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটটিতে ঠিক কী ঘটেছিল, তা নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, কসাই জিহাদ স্বীকারোক্তি দিয়ে জানাচ্ছেন— বালিশ চাপা দিয়ে আনারকে হত্যা করার পর ওই ফ্ল্যাটের বাথরুমে কীভাবে তার মরদেহ টুকরো টুকরো করে ফ্ল্যাশ করা হয়।
হত্যার পর আনারকে বেঁধে রাখার চিত্রও প্রকাশ পেয়েছে ভিডিওতে। এতে দেখা যাচ্ছে— অজ্ঞান করার রাসায়নিক ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে তাকে বালিশ চাপা দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি খুনিরা। মৃত আনারকে চেয়ারে বসিয়ে তার হাত ও পা শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়। জিহাদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ফ্ল্যাটের বাথরুমে টুকরো টুকরো করে আনারের দেহাংশ ফ্লাশ করে দেওয়া হয়।
ট্রিপ্লেক্স সেই ফ্ল্যাটের বসার ঘরে আনারকে স্বাগত জানান শিলাস্তি। পরে আসে জিহাদ। তখন শিলাস্তিকে নিচের ফ্ল্যাটে যেতে বলা হয়। পুলিশ জিহাদকে নিয়ে ফ্ল্যাটের নিচে নামার পর জিহাদ দেখায় কোথায় বালিশ চাপা দিয়ে আনারকে হত্যা করা হয়।
নজরদারিতে ৬ মডেল ও এক নায়িকা
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ছয় মডেল ও এক নায়িকাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। টলিউডে (কলকাতা) একাধিক সিনেমায় অভিনয় করা এই নায়িকা ও ছয় মডেলকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে ডাকা হতে পারে। এমপি আনার হত্যা মামলার তদন্তে থাকা ডিবি-সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
ডিবির সূত্র বলছে, আনার হত্যায় মূল পরিকল্পনাকারী শাহিন এখন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি কলকাতায় যাওয়ার সময় যেমন শিলাস্তি রহমান ছিল তেমনি অন্য মডেলরাও ছিল। সাথে একজন নায়িকাও ছিল। তাদের মধ্য থেকে তিনি নায়িকাকে কলকাতার পঞ্চলা ও গৌরবতীর ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় ৩০ বছর বয়সী সেই নায়িকা কলকাতার একাধিক সিনেমায় অভিনয় করে সুনাম কুড়িয়েছেন। ঢাকার গোয়েন্দারা এসব তথ্য জানতে পেরেছে কলকাতার সিআইডির কাছ থেকে।
ডিবির আরেকটি সূত্র জানায়, এরমধ্যে তারা বেশি সন্দেহ করছেন নায়িকাকে। কারণ তিনি কলকাতায় শাহিনের কাছেই ছিলেন। শাহিন তার কাছে হত্যার তথ্য শেয়ার করেছে কিনা তা তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানতে চাইবে। যদিও তাকে এখনো ডাকা হয়নি।
ডিবি সূত্র বলছে, সংসদ সদস্য আনার হত্যায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নাম আসছে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেছেন, আমাদের তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে বিভিন্ন ধরনের তথ্য আছে। যখন যাকে প্রয়োজন মনে করবেন তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকবেন। আপনারা জানেন আমরা কাউকে হয়রানি করি না এবং কেউ অপরাধী হয়ে থাকলে তাকে পালানোর সুযোগও দেই না। আমি আগেই বলেছি, তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারলে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নজরদারিতে ঝিনাইদহ আ.লীগের চার নেতা!
আনার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নতুন মোড় নিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি সামনে আসার পর প্রথমে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলেছিলেন— স্বর্ণের চোরাচালানকেন্দ্রিক বিরোধ ও লেনদেনের জেরে হত্যা করা হয়েছে তাকে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন ধোঁয়ায় মিলিয়ে গেল সেই ধারণা। হঠাৎই সামনে এলো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়।
সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত খবর ও ডিবির সূত্র বলছে— আনার হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে গ্রেফতার ও আটক করেছে ডিবি। তাদের মধ্যে একজন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু। এমপি আনারকে অপহরণ ও গুমের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তাকে।
অপরজন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। গতকাল এমপি আনার হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে রাজধানীর ধানমণ্ডি থেকে আটক করা হয় তাকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) স্থানীয় আওয়ামী লীগের এই নেতাকে আটক করে।
ডিবির সূত্র জানিয়েছে— গতকাল বিকেলে ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতার বাসাসংলগ্ন এলাকা থেকে সাইদুল করিম মিন্টুকে আটক করা হয়। এমপি আনোয়ারুল হত্যার ঘটনায় এর আগে গ্রেফতার ব্যক্তিদের তথ্যের ভিত্তিতে তাকে আটক করা হয়। তাকে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে তার সম্পৃক্ততা মিললে তাকে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে।
গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রটি বলছে, এমপি আনোয়ারুল হত্যার পর খবর পাওয়া এবং নিজেদের মধ্যে ছবি চালাচালি করা ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত চার নেতাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ঘটনা জেনেও কেন তারা গোপন রেখেছিলেন, তারা কীভাবে ছবি পেলেন, হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কি না— এসব বিষয় খতিয়ে দেখছে পুলিশ। নজরদারিতে থাকা নেতাদের দেশত্যাগে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হতে পারে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ভারতের কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসে মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহিনের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে গত ১৩ মে এমপি আনোয়ারুলকে হত্যার পর খুনিরা ছবি পাঠায় ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগ নেতা কাজী কামাল ওরফে গ্যাস বাবুর কাছে। ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের আরও দুই শীর্ষ নেতার কাছেও সেই ছবি পাঠানো হয়। তাদের একজন সাইদুল করিম মিন্টু। অপর শীর্ষ নেতা ছাড়াও ঝিনাইদহ পৌর আওয়ামী লীগের এক নেতা ও জনপ্রতিনিধি, কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতা এবং কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নজরদারিতে রয়েছেন। তারা এই হত্যার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার আগেই জানতেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলেন, হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া ও শিলাস্তি রহমানের জবানবন্দিতে এবং মোবাইল ফোনে কথোপকথনের সূত্র ধরে ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগের নেতাদের নাম আসছে। যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক আখতারুজ্জামান শাহিন ঘটনার আগে-পরে যাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তাদের বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছে ডিবি। তারা যাতে দেশত্যাগ না করতে পারেন, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক রয়েছে।
উল্লেখ্য, ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত ১১ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। প্রথমে কলকাতার বরাহনগরে তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন। এরপর স্থানীয় থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। তদন্ত শুরু হয় দুই দেশে। ২২ মে সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে— নিউটাউনের এক বাড়িতে খুন হয়েছেন এমপি আনার। এরপরেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ভারতের পুলিশের বরাত দিয়ে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এনএইচ