সেনাবাহিনীকে হটিয়ে রাখাইন দখলের দাবি আরাকান আর্মির
Share on:
সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেওয়ার দাবি করেছে ওই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করে আসা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)।
থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের ইংরেজি দৈনিক দ্য ইরাবতির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরাকান আর্মি (এএ) বলেছে, তারা রাখাইন রাজ্যের ১৭টি শহরের মধ্যে অন্তত ১৫টি এবং প্রতিবেশী চিন রাজ্যের পালেতওয়া শহরের দখল সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করেছে। এই দুই রাজ্যে সেনাবাহিনীর ১৪২টি সামরিক চৌকির দখলও নিয়েছে তারা।
এছাড়াও দেশটির দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় স্যাগাইং অঞ্চলের ভারত সীমান্তের কাছের শহর খামপাতও দখল করেছে সেখানকার বিদ্রোহীগোষ্ঠীগুলো। শহরটির নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে গত ১০ ডিসেম্বর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন ২২৮ ও ৩৯১ এর প্রায় ২০০ সৈন্য লড়াই করছে। বিদ্রোহীদের অবস্থান লক্ষ্য করে স্থল ও আকাশপথে হামলা চালাচ্ছে সামরিক বাহিনী।
আরাকান আর্মির এক বিবৃতিতে বলা হয়, গত ৪৫ দিন ধরে রাখাইন ও চিন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে বিদ্রোহীরা। এ সময় রাখাইনের রাজধানী সিত্তের একটি এবং অন্য ১৪টি শহরের সামরিক ঘাঁটিগুলোর দখল নিয়েছে তারা। এছাড়া চিন রাজ্যের পালেতওয়া শহরে জান্তা বাহিনীর ১৭টি ঘাঁটির দখলও নিয়েছে বিদ্রোহীরা।
উত্তর রাখাইন রাজ্যের ম্রাউক ইউ, পাকতাও ও মংডু শহরে এবং দক্ষিণ চিনের পালেতওয়াতে সামরিক বাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের সংঘর্ষ চলছে। গত বুধবার ম্রাউক ইউ শহরের কোয়ে থাউং গির্জার কাছে আরাকান আর্মি ও সামরিক বাহিনীর মাঝে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এই সংঘাতে জান্তা বাহিনীর ব্যাপক সংখ্যক সদস্যের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। পরে বিদ্রোহীদের অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় মিয়ানমারের জান্তা।
রাখাইনের ম্রাউক ইউ শহরের বাসিন্দারা বলেছেন, পায়ার ওয়াক, ইওয়ার হং তাও, পিপিন কোন ও মং থার কোন গ্রামে সামরিক বাহিনীর বিমান থেকে হামলা চালানো হয়েছে।
স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেছেন, বিমান হামলায় কোনও বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে কিছু বাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও গির্জার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইরাবতি বলছে, চলতি সপ্তাহে মংডু এবং পাকতাও শহরে সামরিক বাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।
একই সঙ্গে পালেতওয়ায় জান্তা বাহিনীর একটি প্রধান ঘাঁটিতে আরাকান আর্মি টানা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে গোষ্ঠীটি। ইতিমধ্যে এই শহরে জান্তার দুটি শক্তিশালী ঘাঁটির দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি।
দেশটির এই সংবাদমাধ্যম বলছে, মঙ্গলবার পালেতওয়া শহরের প্রায় ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সিনলেৎওয়ার একটি জান্তা ফাঁড়িতে হামলা চালিয়েছে বিদ্রোহীরা। পালেতওয়ার একজন বাসিন্দা বলেছেন, সিনলেৎওয়ার গ্রামের বাসিন্দারা জঙ্গলে পালিয়ে গেছেন। ওই এলাকায় ফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না।
আরাকান আর্মির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াই শুরু হওয়ার পর গত ১৩ নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত রাখাইনের কমপক্ষে ৩০০ বাসিন্দাকে গ্রেপ্তার করেছে জান্তা। কেবল গত সোমবার ও মঙ্গলবার সিত্তে, মিনবিয়া, কিয়াউকতাও, ম্রাউক ইউ এবং পাকতাও শহরের অন্তত ৬০ বাসিন্দাকে আটক করা হয়েছে।
দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির রাজনৈতিক দল এনএলডি নির্বাচনে জয়ের পর ক্ষমতায় তাদের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর ঠিক আগে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। তারপর থেকেই দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাত শুরু হয়েছে দেশটির বেসামরিক জনগণ ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর। সম্প্রতি দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো জোট গড়ে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করেছে।
দেশটির কয়েকটি ফ্রন্টে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের হামলায় লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বিদ্রোহীদের কাছে নিজেদের ঘাঁটি ও নিরাপত্তা চৌকির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা বাহিনী।
বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট নামের একটি জোট গঠন করে গত অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে হামলা শুরু করে। দেশটির উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলীয় চীন সীমান্ত লাগোয়া একাধিক শহর ও সামরিক নিরাপত্তা চৌকির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এই জোটের সদস্যরা।
গত ১১ ডিসেম্বর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র জ্য মিন তুন বলেন, ‘‘মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য ও শান্তিপ্রক্রিয়া সমন্বয় কমিটি চীনের সহায়তায় বিদ্রোহীগোষ্ঠী এমএনডিএএ, টিএনএলএ এবং এএর প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছে।’’
মিয়ানমারের দুই-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ডজুড়ে সামরিক বাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের সংঘর্ষ চলাকালীন ওই বৈঠকের বিষয়ে জানিয়েছে জান্তা। বিদ্রোহী-জান্তার লড়াইয়ে গত কয়েক মাসে ৩৬০ জনের বেশি বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি ঘটেছে। এই সংঘাতে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন পাঁচ লাখের বেশি মানুষ।
এসএম