মণিপুরে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা
Share on:
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে সহিংসতা চলছে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে। ইন্টারনেট বন্ধ রাখাসহ নানা ধরনের পদক্ষেপের পরও সহিংসতা-অস্থিতিশীলতা তো কমেইনি বরং সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যটিতে ভারতের এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা সামনে এসেছে।
বাড়ির ভেতরে আটকিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দেওয়ার পর আগুনে পুড়িয়ে তাকে হত্যা করা হয়। শনিবার (২২ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহিংসতায় বিধ্বস্ত মণিপুরে দুই জনগোষ্ঠীর লড়াইয়ে শতাধিক সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। দিন কয়েক আগেই মণিপুরে দুই নারীকে নগ্ন করে ঘোরানোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই ঘটনা নিয়ে উত্তাল গোটা ভারত। সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও।
আর এবার মণিপুরের কাকচিং জেলার সেরোউ গ্রামে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া এক ব্যক্তির বৃদ্ধা স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা সামনে এলো। বেশ কিছুদিন আগে ঘটা এই ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি অভিযোগ দায়ের হয়েছে সেরোউ থানায়। ভারতীয় ওই স্বাধীনতা সংগ্রামীকে পুরস্কৃত করেছিলেন ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এপিজে আব্দুল কালাম।
সেরোউ থানায় দায়ের করা মামলা অনুসারে, কাকচিং জেলার সেরোউয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীর ৮০ বছর বয়সী স্ত্রীকে তার বাড়ির ভেতরে তালাবদ্ধ করার পর একটি সশস্ত্র দল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং তাকে হত্যা করে। তার স্বামীর নাম এস চুরাচাঁদ সিং। তিনি ৮০ বছর বয়সে মারা যান এবং তিনি এমন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন যাকে ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট পুরস্কৃত করেছিলেন।
এনডিটিভি বলছে, গত ২৮ মে এই ঘটনাটি ঘটে। সেসময় সেরোউয়ের মতো জায়গায় ব্যাপক সহিংসতা এবং বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছিল। গত ৩ মে সহিংসতা শুরুর আগে রাজ্যের রাজধানী ইমফল থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি মনোরম গ্রাম ছিল সেরোউ। কিন্তু এনডিটিভি দেখেছে, এখন সেখানে শুধু আগুনে পোড়া বাড়ি এবং দেয়ালে বুলেটের গর্তই কেবল রয়েছে।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, স্বাধীনতা সংগ্রামীর ৮০ বছর বয়সী ওই স্ত্রীর নাম ইবেতোম্বি। ঘটনার রাতে তিনি তার বাড়ির ভেতরেই ছিলেন এবং গ্রামে হামলাকারীরা তাকে ভেতরে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে তারা ওই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
ইবেতোম্বির নাতি ২২ বছর বয়সী প্রেমকান্ত এনডিটিভিকে বলেছেন, পরিবার সদস্যরা যখন তাকে উদ্ধার করতে আসে ততক্ষণে আগুন পুরো বাড়িটিকে ভস্মীভূত করে দেয়। প্রেমকান্ত এনডিটিভিকে বলেন, তিনি খুব অল্প ব্যবধানে সেই রাতে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। এমনকি দাদীকে বাঁচানোর চেষ্টা করার সময় বাহু ও উরুতে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
বাড়িতে হামলার ঘটনার বিষয়ে প্রেমকান্ত বলেন, ‘বাড়িতে হামলা হওয়ার পরপরই দাদী বলেছিল- এখনই পালিয়ে যাও। পরে (আমার জন্য) ফিরে এসো। এরপর আমরা পালিয়ে যাই। তখন বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এগুলোই ছিল তার শেষ কথা।’
এদিকে পুড়ে যাওয়া বাড়ির ভেতর থেকেই এপিজে আব্দুল কালামের হাত থেকে তার দাদার পুরস্কার নেওয়ার ফ্রেমবন্দি ছবি খুঁজে পেয়েছেন প্রেমকান্ত। সেই ছবি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিকে দেখিয়ে ফের কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
উল্লেখ্য, প্রায় তিন মাস ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে মণিপুর রাজ্যের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর মাঝে উত্তেজনা চলছে। গত মে মাসের শুরুর দিকে স্থানীয় কুকি উপজাতিরা তফসিলি উপজাতির মর্যাদার দাবির প্রতিবাদে সংহতি সমাবেশের আয়োজন করে। এই সমাবেশ ঘিরে ওই দিন পার্বত্য এই রাজ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
দীর্ঘ সময় ধরে চলা ওই সহিংসতায় বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এতে কোটি টাকার সম্পত্তি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
এছাড়া রাজ্যের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কুকি গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে সেখানে দফায় দফায় আন্দোলনও হয়। মণিপুর রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ৬৪ শতাংশ মেইতেই সম্প্রদায়ের। তারপরও ওই রাজ্যের মোট ভূখণ্ডের মাত্র ১০ শতাংশের মালিকানা এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের হাতে রয়েছে। ভারতের এই রাজ্যে তফসিলি উপজাতিদের বাইরে পাহাড়ী এলাকায় অন্য কারও জমি কেনার অনুমতি নেই।
সম্প্রতি ভারতের হাইকোর্ট মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতিদের তালিকার অন্তর্ভূক্ত করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। হাইকোর্টের এই নির্দেশের পর নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মণিপুর। মেইতেই সম্প্রদায়ের সদস্যরা তফসিলি উপজাতিদের তালিকায় ঠাঁই পেলে রাজ্যে জমি কেনার অনুমতি পাবেন।
এমআই