tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
রাজনীতি প্রকাশনার সময়: ১৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:৩৭ পিএম

শ্রমিক কল্যাণের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন: সভাপতি শামসুল, সাধারণ সম্পাদক আতিকুর


স

বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের ত্রিবার্ষিক নির্বাচনে ২০২৩-২০২৫ কার্যকালের জন্য আ ন ম শামসুল ইসলামকে সভাপতি ও অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নিবাচিত করা হয়েছে।


সোমবার রাজধানীর একটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে তাদেরকে এ পদে নির্বাচন করা হয়।

সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মাওলানা এ টি এম মা’ছুম। বিশেষ অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা সাবেক এমপি এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ ও আ ফ ম আব্দুস সাত্তার। সভাপতিত্ব করেন ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান। সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান।

সম্মেলনে সারাদেশ থেকে প্রায় চার হাজার কাউন্সিলর ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়েছেন। তাদের মতামতের আলোকে নির্বাচন কমিশন সভাপতি পদে সাবেক এমপি আ ন ম শামসুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক পদে অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমানের নাম ঘোষণা করেন। সভাপতি আ ন ম শামসুল ইসলাম কারাগারে বন্দি থাকায় ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এছাড়া গঠনতন্ত্রের আলোকে ৩৫ সদস্যের কার্যকরী পরিষদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়।

প্রধান অতিথি মাওলানা এ টি এম মা’ছুম বলেন, দেশ আজ চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বর্তমান সরকার বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে দেশে দুঃশাসন চালাচ্ছে। আজ দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। তারা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি দাবি করে দেশকে ভঙ্গুর করে দিচ্ছে। তারা শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে গরিব-মেহনতি মানুষকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। একটি সম্ভাবনাময় দেশকে বিদেশী ঋণের ফাঁদে ফেলে ক্ষমতাসীনরা দেশকে পঙ্গু করে দিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, এই দুঃশাসন থেকে জনগণকে মুক্তি দেয়ার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলনের বিকল্প নেই। সর্বস্তরের মানুষ আজ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠেছে। জনগণকে সাথে নিয়ে মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

এ সময় তিনি এই সংগ্রামে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন অতীতের ন্যায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, পুরো জাতির ওপর শাসকগোষ্ঠী জুলুম-নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাচ্ছে। আজ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ কৃষক-মজুরের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত তারা দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মূলত সরকারের লোকজনের সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট আজকের দুর্দশার প্রধান কারণ। সরকারের লোকজন রাতারাতি হাজার কোটির টাকার মালিক হয়ে গেছে। অন্যদিকে গরিব আরো নিঃস্ব হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, সরকারের দুঃশাসনের সবচেয়ে বড় শিকার শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষরা। তারা এখন একবেলা খেতে পারলে অপর বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। আজকে মানুষ দারিদ্র্যের কষাঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত। আজ শ্রমজীবী মানুষ তাদের বাচ্চাদের জন্য খাদ্য ক্রয় করতে পারছে না। তাদের শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। শ্রমজীবীরা সন্তানদের শিক্ষার খরচ দিতে না পারার কারণে তারা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতির এই দুঃসময়ে শ্রমজীবী মানুষের পাশে শ্রমিক কল্যাণকে দাঁড়াতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান বলেন, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন দেশের মেহনতি শ্রমিকদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। শ্রমিকদের সুখ-দুঃখের অংশীদার। শ্রমিক কল্যাণ নেতৃবৃন্দকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। দেশের যেখানে যখন কোনো শ্রমিকের অসন্তোষ সৃষ্টি হবে, তা দূরীকরণে ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, ২০২৩ সাল জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শ্রমিক নেতৃবৃন্দকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় সৎ লোকের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সারাদেশে শ্রমজীবী মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তৃণমূলে সংগঠনকে গতিশীল করতে হবে। তৃণমূলের সংগঠন শক্তিশালী হলে সংগঠন শক্তিশালী হবে।

ত্রিবার্ষিক কেন্দ্রীয় সম্মেলন-২০২২ এ নিম্মোক্ত প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছে :

১. আজকের এই সম্মেলন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ রূপলাভ করছে। দিন যত যাচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা নাই। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ব্যাংক লুটেরা দেশকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে গেছে। দেশ আজ খাদের কিনারে অবস্থান করছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ও জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার গঠন। তাই এই সম্মেলন অনতিবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে ব্যর্থ সরকারকে পদত্যাগ কারার জোর দাবি জানাচ্ছে।

২. আজকের এই সম্মেলন চাল-ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার ও শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছে।

৩. এই সম্মেলন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাবেক এমপি আ ন ম শামসুল ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছে। একইসাথে তার বিরুদ্ধে সকল প্রকার রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে শ্রমিকদের মাঝে ফিরে দিয়ে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করার সুযোগ দেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছে। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের প্রধান উপদেষ্টা ডা: শফিকুর রহমান ও ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ সকল রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছে।

৪. আজকের এই সম্মেলনে গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে দেশের শ্রমশক্তির ৬৫ ভাগ কৃষি খাতে নিয়োজিত। কিন্তু দেশে এখনোও কাঙ্ক্ষিত কৃষি ভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে না উঠার কারণে কৃষক পণ্যের নায্য মূল্য পায় না। ফলে তাদের আর্থিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এই সম্মেলন সরকারি ও বেসরকারিভাবে কৃষি ভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে তোলার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে।

৫. আজকের এই সম্মেলন হোটেল শ্রমিক ও দোকান কর্মচারীসহ সকল শ্রমিকের জীনযাত্রার ব্যয়ের নিরিখে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো পুনর্নির্ধারণের ও বাস্তবায়নের জোর দাবি জানাচ্ছে। পাশাপাশি পরিবহন, রিকশা, ভ্যান, নির্মাণ, কৃষি, চাতাল, দর্জি, তাঁত, স্টিল রি-রোলিং, ফার্নিচার, হকার্স, দোকান কর্মচারী, নৌ-পরিবহন ও করাতকল শ্রমিকসহ সর্বস্তরের শ্রমিকদের জন্য ট্রেড ভিত্তিক সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করা ও সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে।

৬. আজকের এই সম্মেলন গার্মেন্টস শ্রমিকদের সর্বনিম্ম মজুরি ৮,০০০/- টাকা নির্ধারণ করা হলেও অধিকাংশ গার্মেন্টস মালিক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি না দিয়ে বিভিন্নভাবে শ্রমিকদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এমনকি দাবি আদায়ের আন্দোলনকে দমনের নামে হয়রানি ও গ্রেফতার করে অন্যায়ভাবে শ্রমিকদেরকে চাকুরিচ্যুত করছে। এই সম্মেলন গার্মেন্টস শিল্পে বর্তমানে গৃহীত কালাকানুন টার্মিনেশন অ্যাক্ট বাতিল করে পূর্বের আইন বহাল করার জোর দাবি জানাচ্ছে। এমনিভাবে ২০,০০০/- টাকা সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করে মজুরি কমিশন ঘোষণার জোর দাবি জানাচ্ছে।

৭. আজকের এই সম্মেলন বন্ধ ২৫টি জুট মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের যাবতীয় বকেয়া পাওনাদি অবিলম্বে পরিশোধ করার জোর দাবি জানাচ্ছে। পাশাপাশি বিএমআরই পদ্ধতিতে আধুনিকায়ন করে উক্ত ২৫টি জুট মিলসহ বন্ধ সকল কল-কারখানা অবিলম্বে চালু করার জোর দাবি জানাচ্ছে।

৮. আজকের এই সম্মেলন সরকারি-বেসরকারি ও গার্মেন্টসসহ সকল শিল্প, কল-কারখানায় শ্রম আইন অনুযায়ী মহিলাদের প্রসূতিকালীন ছুটি ও ভাতা প্রদানসহ নারী শ্রমিকদের সন্তানের জন্য শিশু যত্মাগার স্থাপনের জোর দাবি জানাচ্ছে।

৯. এই সম্মেলন আইএলও কনভেনশন মোতাবেক অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন করা শ্রমিকদের অধিকার। কিন্তু শ্রম অধিদফতর শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাই আজকের সম্মেলন শ্রম অধিদফতরের নিকট ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে হয়রানি না করে সহযোগিতা করার জোর দাবি জানাচ্ছে।

১০. এই সম্মেলন গভীর উদ্বেগের সাথে বলছে যে পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে না পারলে পরিবহন শ্রমিকদের দুর্দশা শেষ হবে না। তাই এই সম্মেলন পরিবহন শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান, চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধ করার জোর দাবি জানাচ্ছে।

১১. আজকের এই সম্মেলন মনে করে যে বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন অগ্রগতি মানে দেশের উন্নতি। তাই বাংলাদেশ রেলওয়েকে দ্রুত আধুনিকায়নের পাশাপাশি ঢাকা-লাকসাম-ঢাকা কর্ড লাইন, দোহাজারী-কক্সাবাজার ও বগুড়া, জামতইলসহ সারাদেশে রেলওয়ে সম্প্রসারণ করার জোর দাবি জানাচ্ছে।

১২. আজকের এই সম্মেলন মনে করে যে শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত সমস্যার সমাধান কুরআন-সুন্নাহর আইন প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই ইসলামি শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে শ্রমজীবী মানুষসহ সকল স্তরের শ্রমিক জনতাকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের পতাকাতলে শামিল হওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছে।

এমআই