ধর্মহীনতার ক্রমবিকাশ: সৈয়দ উসমান গণি
Share on:
নাস্তিকদের অনেকে আবার বিভিন্ন নামে পরিচিত হতে পছন্দ করে। কেউ প্রগতিশীল, কেউ মুক্তমনা, কেউ মানবধর্মের অনুসারী, কেউ উদারপন্থী ইত্যাদি। যে নামেই পরিচিত হোক, তাদের অবস্থান ধর্মের গণ্ডির বাইরে।
যুগযুগ ধরে মানুষের আচরণে, বিশ্বাসে ধর্মভীরুতা এবং ধর্মহীনতা বা নাস্তিকতা এ দুটো দিকই পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। বিশ্বাসহীনতা থেকেই নাস্তিকতার উদ্ভব আর বিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি হয় অজ্ঞতা, কুশিক্ষা, কুচিন্তা, কুযুক্তি, কুসঙ্গ ইত্যাদি কারণে।
যারা ধর্মহীন তারা আল্লাহ্ তা'লা /সৃষ্টিকর্তা /ঈশ্বর (বিভিন্ন ধর্মমতে) এবং তার আদেশ নিষেধ, পরকাল এবং পুরস্কার বা তিরস্কার এসবের কিছুই বিশ্বাস করেন না, মানেন না। এদেরই এক কথায় নাস্তিক বলা হয়ে থাকে। এরা প্রকৃত পক্ষে' কাফির', বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানগণ যাদের কাফের বলে থাকেন। যে কোনো লোকেরই মুমিন হওয়ার বা কাফের হওয়ার অধিকার রয়েছে। আল্লাহ তা'লাই তাকে সে সুযোগ করে দিয়েছেন এবং পাশাপাশি যথাক্রমে অফুরন্ত সুখ অথবা ভীষণতম স্থায়ী আযাবের অগ্রিম ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন (সুরা দাহর, আয়াত নং - তিন এবং চার দ্রষ্টব্য)।
ধার্মিকদের মধ্যে হাজারো রকমের বিভক্তি বিদ্যমান। অধিকাংশ লোকই নিজেদের বিশ্বাস ও বুদ্ধিমত্তার উপর ভিত্তি করে পছন্দমতো নিজ নিজ ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে, কেউকেউ আবার নিজেদের স্রষ্টাকেই সৃষ্টি করে নিয়ে তার উপাসনা করে যাচ্ছে (আউযুবিল্লাহ্)।
এদের মধ্যে একটা শাখা আছে যারা একেশ্বরবাদী, একেশ্বরবাদী হলেও আবার সবাই মুসলমান নয়। কোনো কোনো একেশ্বরবাদী আছে যারা কোনো কোনো প্রাণীকে তাদের ঈশ্বর মনে করে উপাসনা করে থাকে।
ব্রাহ্মসমাজীরা একেশ্বরবাদী হলেও তারা মুসলিম নয়, কাদিয়ানীরাও মুসলমান নয়। শুধুমাত্র সেই সব একেশ্বরবাদীরা মুসলিম, যারা কোরআন মাজিদকে আল্লাহ তা'লার কালাম এবং তা অভ্রান্ত ও অলঙ্ঘনীয় বলে বিশ্বাস করে এবং তাতে বিবৃত আদেশ নিষেধ মেনে চলতে চেষ্টা করে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তা'লার প্রেরিত সর্বশেষ নবী-রসুল মনে করেন, উনার প্রতিটি কথাকে সত্য ও অকাট্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করেন এবং উনার প্রদর্শীত পদ্ধতিতে জীবন যাপন করার চেষ্টা করেন।
বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে নাস্তিকদের মধ্যেও প্রকারভেদ রয়েছে। এক শ্রেণির নাস্তিক আছে যারা তাদের বিশ্বাসে ও কর্মে নাস্তিক হলেও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য ক্ষতিকর নয়, তারা তাদের বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে অর্থাৎ অনেকটা শান্ত প্রকৃতির।
অপর এক শ্রেণির নাস্তিক আছে, যে প্রাণীগুলো সাধারণত ইসলামবিদ্বেষী হয়ে থাকে, অন্যান্য ধর্মের বিষয়ে তাদের কোনো ঈর্ষা না থাকলেও ইসলাম নিয়ে তাদের প্রচণ্ড মাথাব্যথা, তাদের যতো বিষোদ্গারের লক্ষ্যই হচ্ছে ইসলাম, তারা তাদের ইসলবিদ্বেষী বক্তব্য ও লেখালেখির মাধ্যমে মুসলিম মানসে আঘাত দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে থাকে।
উভয় শ্রেণিরই নাস্তিক হওয়ার পিছনে, ধর্মবিষয়ে এদের পারিবারিক উদাসীনতা ও অজ্ঞতাই অনেকাংশে দায়ী। এদের অনেকের পিতামাতাই বেদীন হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন আবার এমনও অনেকে ছিলেন যারা নিজেরা মুসলমান হলেও, ছেলেমেয়েদের মৌলিক ধর্মীয় শিক্ষা না দিয়ে তাদের জন্য নাস্তিকতার পথ উন্মুক্ত করে দিয়ে গেছেন।
আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষায় যারা উচ্চশিক্ষিত, যারা বিত্তশালী এবং যারা রাজনীতিবিদ আছেন তাদের মধ্যে ধার্মিকতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম আর এদের ছেলেমেয়েরাই অধিক হারে নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও নাস্তিকতার হার অধিক, অবশ্য তার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে, এতো মেধা নিয়ে এতো বিদ্যান একজন লোক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও যদি একটু আলাদা ভাব ধরতে বা দেখাতে না পারে তাহলে তার স্বকীয়তা বলতে তো কিছুই থাকে না। অতএব নতুন একটা ভাব ধরা চাই-ই চাই! পদস্থ কর্মকর্তা এবং বড়বড় ব্যবসায়ীদের অবস্থাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতোই।
নাস্তিকদের অনেকে আবার বিভিন্ন নামে পরিচিত হতে পছন্দ করে। কেউ প্রগতিশীল, কেউ মুক্তমনা, কেউ মানবধর্মের অনুসারী, কেউ উদারপন্থী ইত্যাদি। যে নামেই পরিচিত হোক, তাদের অবস্থান ধর্মের গণ্ডির বাইরে।
ধর্মহীনতার একটা সুবিধার দিকও আছে বৈকি। প্রথমেই যাকাতের কথায় আসি, মুসলমানদের প্রতি বছর হিসাব করে নিজের উপার্জিত অর্থ থেকে , অবস্থানুসারে যাকাত দিতে হয় কিন্তু ধর্মহীনদের ওই টাকাগুলো খরচ করতে হয় না। অনুরূপভাবে ফিতরা আদায় করা, কুরবানি করা, হজ করা ইত্যাদি বড়ো বড়ো খরচগুলো থেকে, শুধু মুসলিম না হওয়ার কারণে, সে অব্যাহতি পেয়ে যায়।
মুসলমানগণ বাধ্যতামূলকভাবে বছরে এক মাস সহ অন্যান্য মাসে দু'চারটি করে সিয়াম পালন করে থাকেন, ধর্মহীনদের এই অনাহারে কষ্ট করার দরকার হয় না। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রেও সে সাপ-ব্যাঙ-শুকর-মদ সবই খেতে পারে, কারণ তাদের নিকট হারাম বলতে তো কোন কিছুই নেই।
মুসলমানদের প্রতিদিন অন্তত পাঁচ বার পূতপবিত্র হয়ে নামাজ আদায় করতে হয়, এতে প্রতি ওয়াক্তে আধা ঘন্টা করে সময় ধরলেও দিনে অন্তত আড়াই ঘণ্টা সময় লেগে যায়, একজন নাস্তিকের ওই শ্রম এবং সময়টাই বেঁচে গেল বরং পবিত্র হওয়ার জন্য কোন চিন্তা-চেষ্টাও করতে হলো না, ফোঁটাফোঁটা মূত্র ঝরে না হয় নিজের প্যান্টেই শুকিয়ে থাকলো, সমস্যা নাই। ওদের মরণেও কিছু সুবিধা আছে, কাফন-দাফন ইত্যাদির কোনো ঝামেলা নাই, লাশটা কোথাও দান করে দিলেই হলো বা মৃত প্রাণীর মতো কোথাও মাটিতে পুতে রাখলেই ঝামেলা শেষ!
কিছু কিছু নাস্তিকের জন্য একটা বাড়তি সুবিধা হলো, তারা সারা জীবন উপরোক্ত সুবিধাগুলো ভোগ করার পর নাস্তিক হিসেবে মারা গেলেও তার পরিবারের জীবিত সদস্যরা তাকে মরণোত্তর মুসলিম সাজিয়ে মুসলিমরীতিতে কাফন দাফনের ব্যবস্থা করে থাকে, আলেমদেরই কেউ না কেউ, লোভেই হোক অথবা ভয়েই হোক তার জানাজায় ইমামতি করে থাকেন। আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক নাস্তিকের মৃত্যুতেই এমনটা ঘটেতে দেখা গেছে। এতো সমস্ত সুবিধা প্রত্যাখ্যান করে যারা মুসলমান হিসেবে জীবনযাপন করে থাকেন, নাস্তিকদের দৃষ্টিতে তারা বোকাই বটে।
উচ্চশিক্ষিত আর উচ্চবিত্ত বা রাজনীতিকদের মধ্যে কিছু লোক এমনও আছে যারা নিজেদের মুসলিম দাবি করলেও মুসলমানদের জন্য দৃশ্যমান যে করণীয় বিষয়গুলো রয়েছে তার অনেক কিছুই তাদের মধ্যে অনুপস্থিত, আর বর্জনীয় যা ছিল তার অনেক কিছুরই উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। তাদের নিকট ইসলাম ধর্মটা হচ্ছে '' তাউইর আমলের ঘর'' টার মতো।
তাহলে "তাউইর আমলের ঘরটা" সম্পর্কে কিছু জেনে নেওয়া যাক। তাউই, (বাপের দাদা) নাম ছিল শাহবাজ। তিনি তার যৌবনে একটা ঘর তৈরি করেছিলেন। তার জীবদ্দশাতেই, শেষের দিকে ঘরটি নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। শাহবাজের মৃত্যুর পর, তার পুত্র আয়াজ, বাপের ঘরটির খুঁটিগুলো বদলে ফেলে ঘরটি মজবুত করলেন। ১৫/২০ বছর পর দেখা গেল ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে, পরে আয়াজ নিজেই তার বাপের ঘরের রুইয়া-আঠন সহ চালের সম্পূর্ণ টিন পাল্টে দিলেন এবং ছেলে নিয়াজকে ডেকে বললেন তোমার দাদার হাতের এ ঘরটা যেন নষ্ট না হয়। আয়াজের মৃত্যুর পর ছেলে নিয়াজ ( শাহবাজের নাতি) দেখলো, ঘরের বেড়াটা একেবারে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। সে তখন ঘরের চালটা ঠিক রেখে, বেড়া ও খুঁটিগুলো ফেলে দিয়ে তদস্থলে পাঁচ ইঞ্চি ওয়াল করে ঘরটার স্থায়িত্ব বাড়িয়ে দিলো। নিয়াজের বার্ধক্যে তার ছেলে শিরাজ যখন অনেক টাকাপয়সা উপার্জন করা শুরু করলো, নিয়াজ ছেলেকে বললেন, তোমার তাউইর হাতের এ ঘরটা যেন নষ্ট না হয়, এটার যত্ন নিও। পিতার মৃত্যুর পর শিরাজ এবার ঘরের মেঝেটা টাইলস করলো, ঘরের ভিতরে - বাইরে সুন্দর রং করালো। ঘরের গেটের উপরে খোদাই করে লিখে রাখলো "তাউইর হাতের ঘর", স্থাপনকাল ১৮৮৫ সন ই:। যদিও তাউই (শাহবাজের) এর সময়ের কোনো কিছুই আর ঘরের মধ্যে অবশিষ্ট নেই তবুও তাউই'র ঘর।
ঠিক এরকমই হয়েছে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অধিকাংশ লোকের হাতে ইসলামের অবস্থা, যে ইসলামকে অনেকে 'মডারেট ইসলাম' বলে থাকেন। যারা ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোকে মনেপ্রাণে আকড়ে ধরে রাখতে চাইছে, এই মডারেটপন্থীরাই তাদেরকে 'মৌলবাদী' আখ্যা দিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাচ্ছে। যে যেমনই করুক আর যাই ভাবুক, মনে রাখতে হবে, চূড়ান্ত ফয়সালা আল্লাহ তা'লার হাতে। "ফাল্লাহু খাইরুন হাফিযাউ ওয়া হুয়া আরহামুর রাহিমিন" (আয়াতাংশ)।
মুসলমানগণ বিশ্বাস করেন যে, এক সময় কিয়ামত সংঘটিত হবেই এবং তাতে একমাত্র মহামহিম ও সম্মানিত আল্লাহ তা'লার সত্তা ছাড়া সমগ্র মহাবিশ্বের সকল কিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে ( ছুরা আর রাহমান, আয়াত নং- ২৬ এবং ২৭ দ্রষ্টব্য )।
সারা দুনিয়াতে একজন মুসলমান জীবিত থাকতেও কিয়ামত সংঘটিত হবে না। এখন দাবি করা হয় যে, বিশ্বে প্রায় দেড়শত কোটি মুসলমানের বাস। এখান থেকেই প্রজন্ম পরম্পরায় ঈমান হারা হতে হতে এক সময় দুনিয়াতে একজন মুমিনও আর অবশিষ্ট থাকবে না আর তখনই শুরু হয়ে যাবে মহা বিভীষিকাময় কিয়ামত।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কিয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার পিছনে মুসলমানদের ভূমিকাও কম নয়। হাল আমলে মুসলমানদের ঘরে জন্ম নেয়া জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলেও তার মধ্য থেকে ঈমানদার হচ্ছে খুবই কম এবং তা ক্রমহ্রাসমান।
অধিকাংশ বাবা-মাই তার সন্তানকে ধর্মের মৌলিক বিষয়টুকু শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সন্তানগণ যাতে পিছিয়ে না পড়ে, সে জন্য বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার পিছনে এমনভাবে তাকে লেলিয়ে দেয় যে, সে আর তার ধর্মীয় মৌলিক শিক্ষা এবং জীবনে তার প্রয়োগের কথা ভাবার সুযোগই পায় না।
ভবিষ্যতে ওই সকল সন্তানের ঘরে আবার যে সকল সন্তান জন্ম নিবে, তারা যে শতভাগ নাস্তিকে পরিণত হবে, তাতে আর সন্দেহের কোনো কারণ দেখি না। অতএব, এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে বিশ্বব্যাপী মুসলিম নিধনের জন্য মুসলিম বিদ্বেষীদের আর ব্যয়বহুল যুদ্ধের প্রয়োজন হবে না।
আর অল্প কিছু সংখ্যক মুসলমান, যারা ইসলামকে প্রাণপণে আকড়ে ধরে রাখতে চাইবে, জেল-জুলুম-নির্যাতন করেই তাদের দমিয়ে রাখা এবং তিলে তিলে নি:শেষ করে দেয়াও সম্ভব হবে।
হে মুসলমান, করজোড়ে মিনতি রাখতে চাই, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উনার প্রিয় সাহাবিগণ (রাজিআল্লাহুআনহুম) অপরিসীম ত্যাগের মধ্য দিয়ে দুনিয়াতে যে ইসলাম কায়েম করে গেছেন, আমরা যেন তাকে দুনিয়া থেকে মুছে যেতে না দেই।
আমরা আমাদের সন্তানদের ধর্মের মৌলিক শিক্ষাটা থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে তাদের যেন নাস্তিকতার দিকে ঠেলে না দেই। আমাদের উদাসীনতার কারণে, আমরা মুসলমানরাই যেন কিয়ামতকে ত্বরান্বিত না করি।
লেখক:
প্রাক্তন সহকারী অধ্যাপক
মির্জাপুর কলেজ, টাংগাইল।