বিনিয়োগ বান্ধব বাজেট চাই
Share on:
মো: মাঈন উদ্দীন : আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পরিকল্পনা করছে সরকারের অর্থমন্ত্রণালয়। এই বাজেট প্রণয়নে সরকারকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় আনতে হচ্ছে : যেমন, রাজস্ব আয় বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বাজেট ঘাটতি সীমার মধ্যে রাখা, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো ইত্যাদি। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের বিষয়টিও রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি মুদ্রার বিনিময় হারে অস্তিরতা, প্রবাসীদের পাঠানো আয় বা রেমিট্যান্স, ভর্তুকি চার্জ আসন্ন বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ।
চলমান অর্থবছরে (২০২২-২৩) বাজেটের আকার হলো ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে সাত লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের তুলনায় ১৩.৫ শতাংশ বেশি। আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হচ্ছে ৭.৫ শতাংশ, যা অতি উচ্চাভিলাষী মনে হয়। আগামী বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এতে আগামী বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৫ শতাংশ। আসন্ন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে সীমিত রাখার কথা বলা হচ্ছে। যা অর্জন করা বেশ কঠিন। কারণ মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৩৩ শতাংশ। সদ্যসমাপ্ত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৯.২৪ শতাংশ (বিবিএস তথ্য) মার্চের তুলনায় এপ্রিলের মূল্যস্ফীতি ০.৯ শতাংশ কমেছে। সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাজারে জিনিসপত্রের দামে স্বস্তি নেই। পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতির সঠিক তথ্য আসছে না। কারণ বিবিএস এখনো সনাতন পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করছে। তবে সম্প্রতি আইএমএফ-এর নির্দেশনা মতে নতুন পদ্ধতিতে বিবিএস ৭২০টি পণ্যের ওপর ভিত্তি করে হিসাব করবে। বর্তমানে ৩০০টি পণ্যের ওপর ভিত্তি করে এসব করা হয়। আমাদের শিল্পের কাঁচামাল ক্রয়, ক্যাপিটেল মেশিনারির জন্য আমদানি করতে হয়। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তাই মূল্যস্ফীতি কমানো কঠিন হতে পারে। সরকারের রাজস্ব আহরণ সন্তোষজনক নয়, ফলে সরকার ব্যাংক থেকে বর্ধিত মাত্রায় ঋণ গ্রহণ করছে। সরকার বেশি মাত্রায় ঋণ গ্রহণ করলে অভ্যন্তরীণ বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে যায়, যা মূল্যস্ফীতি উসকে দিতে পারে।
আগামী অর্থবছরে বাজেটে ভর্তুকির প্রস্তাব করা হচ্ছে এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের তুলনায় তা ৩৫ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ৮১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে সরকারের নেয়া ঋণের বিপরীতে সুদের বরাদ্দ রয়েছে ৭৯ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। এই ঋণের পরিমাণ বাড়ার কারণ হলো টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। এ দিকে আইএমএফ বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। চলতি বাজেটে গ্যাস খাতে ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। আগামী বাজেটেও এই ভর্তুকি রাখার প্রস্তাব রয়েছে। তবে বিদ্যুৎ খাতে চলতি অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেটের ছয় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দসহ) আগামী বাজেটে এই খাতে ভর্তুকি বাড়তে পারে। তবে বাজেটের ভর্তুকি কোন কোন খাতে কত টাকা তার যৌক্তিকতা দেখা উচিত। নতুন বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) হতে পারে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বরাবরের মতো আগামী অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট উপস্থাপন হতে যাচ্ছে। আগামী বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ থেকে ৯৪ হাজার কোটি টাকা, বিভিন্ন অনুদান ও বাজেট সহায়তা ফান্ড থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা এবং জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য খাত থেকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি মেটাতে পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকারের অর্থ বিভাগ। রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে সুদ ব্যয় থাকবে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি দেখানো হয়েছে; যা মোট বাজেটের ৩৬ শতাংশ। ঘাটতি বাজেট বড় রকমের ব্যবধানে হলে এটি সামাল দেয়া ও ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করা ঠিক হবে না।
বাজেট প্রণয়নে আরো যে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত তা হলো কর জিডিপি রেসিও। জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের যে হার তা তুলনামূলক কম। গত অর্থবছরে দেশের কর জিডিপি রেসিও ছিল ৭.৫৯ শতাংশ। বিশ্বের খুব কম দেশেই এত স্বল্প কর আদায় হয়। আগামী বাজেটে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির প্রতি জোর দেয়া উচিত। প্রতি বছর রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, তা পূরণ করা সম্ভব হয় না। এতে বছর শেষে ঘাটতি দেখা দেয়। ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার ঋণ নিতে বাধ্য হয়। রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও আদায়ের মাধ্যমে ঘাটতি সামাল দেয়া উচিত। প্রতি বছর বাজেট পেশকালে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির নানা কৌশলের কথা বললেও বছর শেষে এই ঘাটতি থেকেই যায়। এখানে মান্ধাতার আমলের নিয়মেই কর রাজস্ব আয় আদায় হয়। ফলে কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য সংযত বাজেট দরকার। বড় ধরনের ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করলেও বাজেট বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। ঘাটতি মোকাবেলায় বৈদেশিক ঋণের ওপর চাপ কমাতে উৎপাদান বাড়াতে হবে। কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। দেশের বিদ্যমান আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। প্রতি বছর অর্থনীতি বিশ্লেষকরা এ বিষয়ে বলা হলেও কাক্সিক্ষত মাত্রায় বাড়ানো হচ্ছে না।
বাজেটের লক্ষ্য পূরণে কতগুলো খাতকে গুরুত্ব দেয়া উচিত- যেমন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও নিম্ন মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা, সরবরাহব্যবস্থা গতিশীল ও শক্তিশালী করা, আমদানিপণ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা করা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা, গরিব ও অসহায়দের মধ্যে স্বল্প মূল্যে খাদ্য বিতরণ এবং বিদ্যুৎ, গ্যাস ও কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া। বাজেটের সময় হলে প্রতি বছর সামাজিক নিরাপত্তা খাত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে নানা আলোচনা হলেও গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। ফলে বাজেট আসে, বাজেট যায়; কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের জন্য এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হবে। চলমান ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতের বরাদ্দ দেখানো হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ২.৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন ২৮ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রের সুদ সহায়তা বাবদ সাত হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। এভাবে সরকার প্রতি বছর বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বড় আকারে চিত্র দেখালেও বাস্তবে যা অনেক কম। বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত বহুল আলোচিত। এই দুই খাতে নানাভাবে দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা শোনা যায়। বাস্তবতার নিরেখে এই গুরুত্বপূর্ণ খাত দু’টিতে বরাদ্দ ও তার সঠিক ব্যবহার করার পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ইউনেস্কোর মতে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ থাকা উচিত জিডিপির ৬ শতাংশ, সেখানে বর্তমানে রয়েছে ২ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় ৫ শতাংশ থাকা উচিত, বর্তমানে আছে ১ শতাংশেরও কম। আগামী বাজেটকে জনবান্ধব করতে হলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতকে জবাবদিহির আওতায় এনে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সাথে ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো ব্যাংকিং সেক্টর। অন্যান্য দেশে বিনিয়োগের পুঁজি সরবরাহের বিভিন্ন সেক্টর থাকলেও আমাদের অর্থনীতি ব্যাংকনির্ভর। আমাদের শেয়ারবাজারও তত শক্তিশালী নয়। তাই ব্যাংকিং সেক্টরের মজবুতির ওপর দেশের আর্থিক খাত নির্ভরশীল। অথচ এই খাত নানা সমস্যায় জর্জরিত। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। খেলাপি ঋণ দিন দিন বাড়ছে। ঋণ আদায়ের হার অনেক কম। ফলে বিনিয়োগ আমানত রেসিও (আইডিআর) যৌক্তিক অবস্থায় নেই। ব্যাংকবহিভর্‚ত অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। বিনিয়োগ প্রদান ও আদায়ের ক্ষেত্রে যেসব নিয়ম ও শর্ত রয়েছে তা পরিপালনে নানা দুর্বলতার পাশাপাশি সুশাসন ও জবাবদিহির ঘাটতির কারণে এই খাতের সমস্যার উত্তরণ এখনো সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের বণিক সমাজ ও ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট ও সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই খাতের সমস্যা দূর হওয়ার নয়।
ডলার সঙ্কট ও বৈশ্বিক সঙ্কট এ খাতকে আরো দুর্বল করেছে। ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা হলো নন পারফরমিং লোনের ক্রমাগত বৃদ্ধি বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সার্কুলার ও চিঠি ইস্যু করেও খেলাপি কমাতে পারছে না। এ জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করে প্রতি বছর সরকার রাজস্ব আদায় জোরদারের কথা বললেও সঠিক লক্ষ্যে আদায় হচ্ছে না। তার ওপর রয়েছে বাড়তি মূল্যস্ফীতি, ডলার সঙ্কটসহ নানা চাপ। এর মধ্যেও সরকারকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। গরিব, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষকে আরো বেশি সুরক্ষার আওতায় আনা উচিত। বিনিয়োগের পরিবেশ সুরক্ষা, ব্যাংক খাত শক্তিশালী করা, আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করতে হবে। বাজেটের আকার যা-ই হোক না কেন বাজেটে সাধারণ মানুষের আয়ের ওপর কী প্রভাব পড়বে সেই বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রায় মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের শুল্ককর বৃদ্ধির ফলে জনদুর্ভোগ বাড়ে, সেই দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দুর্নীতিরোধ ও সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বাজেট বাস্তবায়ন বাড়ানো অনেকাংশে সম্ভব বলে বিশ্লেষকরা মনে করে। সহনীয় মূল্যস্ফীতি ও সত্যিকারের জনবান্ধব বাজেটই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
এন