আগুনে পুড়ে ছাই বস্তি, খোলা আকাশের নিচে সহস্রাধিক মানুষ
Share on:
নাছির উদ্দিন শোয়েব: রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বিএফডিসি গেইট সংলগ্ন মোল্লাবাড়ি বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে সহায় সম্বল হারিয়ে নিস্ব হয়ে গেছেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ।
আগুনে প্রায় তিন শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঘুমন্ত অবস্থায় দগ্ধ হয়ে এক নারী ও শিশু নিহত হয়েছে। নিহত দু’জন মা ও ছেলে হতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ায় ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন মা ও ছেলেসহ আরো অন্তত আট থেকে ১০ জন। দগ্ধ মা ও ছেলেকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে পুড়ে যাওয়া বস্তিবাসীদের স্থান হয়েছে এখন খোলা আকাশের নিচে। প্রচন্ড শীতের মাঝে চরম মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। এদিকে ফায়ার সার্ভিস এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অন্যদিকে শনিবার (১৩ জানুয়ারি) ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছেন, এটি নাশকতা কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। গতকাল শনিবার ভোরে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও
মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুর জানান, শুক্রবার (১২ জানুয়ারি) রাত ২ টা ২৮ মিনিটে তারা আগুন লাগার খবর পায়। ১৩টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করে। রাত ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তিনি বলেন, বস্তিতে সাধারণত গ্যাস লিকেজ কিংবা শর্ট সার্কিট থেকে আগুনে সূত্রপাত হয়ে থাকে। এ বস্তিতেও একই কারণে আগুন লেগেছে বলে আমাদের প্রাথমিক ধারণা। তবে আমরা তদন্তের মাধ্যমে জানতে পারব আসলেই কী কারণে আগুন লেগেছে। এই ঘটনায় দুইজন মারা গেছেন। পরিবারের দাবি অনুযায়ী লাশ শনাক্তকরণের কাজ চলছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুক্রবার মধ্যরাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে হঠাৎ করে তখন বস্তিতে আগুন লেগে যায়। মাঝরাতে হঠাৎই আগুনে ঘুম ভাঙে সবার, শুরু হয় ছুটোছুটি। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো বস্তিতে। পানির ওপর বাঁশ আর কাঠ দিয়ে বানানো মোল্লাবাড়ি বস্তির তিন শতাধিক ঘরে বসতি ছিল অন্তত দেড় হাজার মানুষ। খবর পেয়ে একে একে ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট। আগুন নেভাতে সহযোগিতা করেন স্থানীয়রাও। ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ঘর আর নিম্নআয়ের মানুষগুলোর শেষ সম্বল। বেশিরভাগই বের করতে পারেননি কোনো মালামাল। সব হারিয়ে নিঃস্ব মানুষের আশ্রয় এখন খোলা আকাশের নিচে। তীব্র শীতে অসহায় তারা। আগুন নেভার পর ভোরের আলো ফোটার আগেই পোড়া ছাইয়ে বেঁচে থাকার শেষ সম্বল খুঁজে ফেরার প্রচেষ্টা বস্তিবাসীর। জমানো টাকা, আসবাবপত্র, মাথা গোজার ঠাঁই হারিয়ে অসহায় নিম্নআয়ের এসব মানুষ। এখন পুড়ে যাওয়া ছাই থেকে কিছু খুঁজে পাওয়া যায় কি না- যেটাকে অবলম্বন করে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে, অথবা শেষ সম্বলটুকু খুঁজে ফেরার যে চেষ্টা সেটা এখন চলছে। পাশাপাশি তারা সরকারের কাছে সহযোগিতার আবেদন করেছেন।
প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ফায়ার সার্ভিস ধারণা করছে, অরক্ষিত গ্যাস লাইন কিংবা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বস্তির আগুনগুলো অধিকাংশ শর্ট সার্কিট বা গ্যাসের লাইন থেকে লাগে। এখনকার অবস্থা আমরা নিশ্চিত না। কেউ বলছে শর্ট সার্কিট, কেউ বলছে গ্যাসের লাইন। এটা খতিয়ে দেখতে হবে। এদিকে আগুনের এ ঘটনায় নারী ও শিশুসহ দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আর দুজন দগ্ধ হয়েছেন। তাদের শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে নেয়া হয়েছে। সেখানে তাদের চিকিৎসা চলছে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পুলিশের উপরিদর্শক (এসআই) মেহেদী হাসান জানিয়েছেন, যে দুজন আগুনে পুড়ে মারা গেছে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাদের মধ্যে একজন নারী ও আরেকজন শিশু। তাদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে বিলাপ করছিলেন আলো আক্তার নামে এক নারী। তিনি বলেন, রাত ২টার পর তিনি মোল্লাবাড়ির বস্তিতে আগুন লাগার খবর পান। এক দৌড়ে বস্তিতে গিয়ে দেখেন ঘর জ্বলছে। ছোট মেয়ের, ছেলের খোঁজ পেয়েছেন। কিন্তু বড় মেয়ে শারমিন আক্তার আর তার ছেলে নাফির খোঁজ পাচ্ছেন না। মর্গের সামনে নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলেন শারমিনের স্বামী মিজানুর রহমান। তিনি একজনকে ট্রেনের টিকিট দেখিয়ে বলছিলেন, পরশু দিন (সোমবার) শারমিন ও ছেলে নাফিকে নিয়ে তার জামালপুর যাওয়ার কথা ছিল।
এ জন্য দুই দিন আগে ট্রেনের টিকিটও কেটেছেন। নাফির বাবা মিজানুর ঢাকায় একটি জুতার দোকানে বিক্রয়কর্মীর চাকরি করেন। স্ত্রী শারমিন ও ছেলে নাফি থাকত জামালপুরে। মিজানুর বলেন, তিনি তেজগাঁও এলাকায় একটি মেসে থাকেন। তিনি ছেলেকে দেখতে গিয়েছিলেন। রাতে যখন আগুন লাগার খবর পান, তখন মেস থেকে বস্তিতে যান। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও স্ত্রী আর সন্তানকে খুঁজে পাননি। মিজানুর আরও বলেন, তিনি নিশ্চিত, যে দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তারা তার স্ত্রী ও ছেলে।
ডিএনএ মেলার পর পুলিশ লাশ হস্তান্তর করবে বলে জানিয়েছে। তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জামিল আহমেদ বলেন, ডিএনএর নমুনা পরীক্ষার পর দুজনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পুলিশের ধারণা, তারা সম্পর্কে মা ও ছেলে।
দগ্ধ মা-ছেলে শেখ হাসিনা বার্নে ভতি: মোল্লাবাড়ি বস্তিতে লাগা আগুনে দগ্ধ মা ও ছেলেকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। দগ্ধরা হলেন- নাজমা বেগম (২৫) ও তার শিশু সন্তান মো. নজরুল ইসলাম (৪)। তারা দুজনই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. তরিকুল ইসলাম জানান, তেজগাঁও থেকে আমাদের এখানে দুজন এসেছেন। নাজমা বেগমের শরীরের ২৪ শতাংশ দগ্ধ ও তার ছেলে নজরুল ইসলাম ধোয়ায় অসুস্থ হয়েছে। তাদের দুজনকে জরুরি বিভাগের অবজারভেশনে রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি। দগ্ধ নাজমা বেগম নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার দাসপাড়া ফকির বাড়ির মো. ওমর ফারুকের স্ত্রী। তেজগাঁও এলাকায় আগুনে পুড়ে যাওয়া বস্তিতে তারা বসবাস করতেন।
যা বললেন ডিএমপি কমিশনার: মোল্লাবাড়ি বস্তিতে আগুনটি কোনো দুর্ঘটনা না কি নাশকতা সেটা তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি বলেছেন, আমরা এখানে যতটুকু দেখেছি যে অগ্নিকাÐের সুস্পষ্ট কারণ সেটা নির্ধারণ করা যায়নি। ফায়ার সার্ভিস হয়তো সেটির তদন্ত সাপেক্ষে তাদের প্রতিবেদন দিতে পারে। তারা তদন্ত করবে। তদন্ত করে বলতে পারা যাবে এটা দুর্ঘটনা না কি নাশকতা। গতকাল শনিবার দুপুরে অগ্নিকাÐের ঘটনায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ডিএমপি কমিশনার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন। হাবিবুর রহমান বলেন, গত রাতে (শুক্রবার) শোয়া দুইটায় তেজগাঁও এলাকাধীন রেললাইন বস্তি মোল্লাবাড়ি নামে পরিচিত এফডিসির জাস্ট পেছনে প্রায় ৩ শাতাধিক পরিবার বাস করে। এই পরিবারের বেশিরভাগ মানুষই এই কারওয়ানবাজারে মাছ কাটেন, দিনমজুরের কাজ করেন। গভীর রাতে যখন এখানে অগ্নিকাÐের সূচনা হয় আশপাশের লোকজন জানাজানি হলে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়। কয়েকটি টিম এখানে এসে কাজ করে। পৌনে ৪টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় ভয়াবহতায় ঘটনাস্থলে দুজন নিহত হয়। এদের মধ্যে একজন নারী ও একজন দুই বছরের ছেলে শিশু এবং দুজন হাসপাতালে রয়েছে। তারা হলেন একজন নারী ও একজন শিশু।
বস্তির মালিকানা বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, তারা যতটুকু জানতে পেরেছেন যে, এই বস্তুটির মালিকানা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী একটি বাড়ির মালিক। তিনি এখানে কিছু বস্তির মত ঘর করে। এখান থেকে বের হওয়ার মত তেমন প্রশস্ত কোন রাস্তা নেই। বের হয়েই দেখা যায় রেললাইন। এখানে কোন সড়কের সাথে এটা সংযোগ নেই। এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। নিহতদের পরিচয় বিষয়ে কমিশনার বলেন, যারা নিহত হয়েছে তাদের পরিচয় স্পষ্ট জানা যায়নি কারণ তারা এমনভাবে পড়েছে যে তাদের সনাক্ত করা যাচ্ছে না। তবে দুইজন নিখোঁজ আছে। ধারণা করা হচ্ছে, যারা নিখোঁজ আছে তারাই হয়তো এই দুজন।