খরায় উত্তরাঞ্চলের কৃষকের বোবাকান্না
Share on:
দীর্ঘ অপেক্ষার পর দেশের বেশকিছু জেলায় বৃষ্টি হয়েছে। অথচ উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টির দেখা নেই।
তীব্র গরমে পাবনা, নাটোর অঞ্চলে আম ও লিচুর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। খরার কারণে আম ও লিচুর বোঁটা শুকিয়ে ঝরে গেছে গুটি।
মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঝড়-বৃষ্টির সময় খরা, আবার খরার সময় বৃষ্টি। আগে বৈশাখের শুরুতে ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি হতো। এখন বর্ষাকালেও আশানুরুপ বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় না। আমাদের মতো ক্ষুদ্র কৃষকের পক্ষে প্রকৃতির সহায়তা ছাড়া অতিরিক্ত টাকা খরচ করে আমন ধান চাষাবাদ করা কঠিন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মাঠে দুলছে ধানগাছ। বেশিরভাগ এলাকায় ধানের শিষ পরিপুষ্ট হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মুহূর্তে জমিতে পানি থাকতেই হবে। গাছের গোড়া শুকিয়ে গেলে আর্দ্রতার অভাবে ধান চিটা হয়ে যাবে। ফলে উৎপাদন কমে যাবে।
কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে গেলে ধানে চিটা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেখানে এবার তাপমাত্রা ৩৯-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় ধানে ফুল অবস্থায় পানি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধানগাছের গোড়ায় পানি ধরে রাখা দরকার। সেটা সম্ভব না হলে জমি অবশ্যই ভেজা থাকতে হবে। এ পরিস্থিতিতে তাদের পরামর্শ হলো ধান, আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, জামরুলসহ ফলগাছের গোড়ায় পানি দেওয়া। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নিশ্চিত করা গেলে রোদের তাপ বাড়লেও ফসলের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।
তারা বলছেন, এ তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে রক্ষায় বেগুন, টমেটো, মরিচ, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, পটোল, শসা ও ঢ্যাঁড়শ ক্ষেতে ৩-৪ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। পাতাজাতীয় সবজি যেমন ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, কলমি, লাউশাক ক্ষেতে ২-৩ দিন অন্তর সেচ দেওয়া প্রয়োজন।
মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ সড়কের দুইপাশে বিস্তীর্ণ জমিতে ধান ও নানারকম ফসলের মাঠ। এ অঞ্চলে এখন ভুট্টা চাষের চাহিদা বেড়েছে। সড়কের পাশে শত শত বিঘা জমেতে দেখা মিললো ভুট্টার ক্ষেত। তবে তীব্র গরম ও রোদের কারণে এখানকার অনেক জমিই ঝলছে গেছে। পরিপক্ক হওয়ার আগেই পুড়ে গেছে গাছের পাতা ও ফল। হলুদ বিবর্ণ ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে কৃষকের হতাশার চিত্র মিলছে পথে পথে।
পথের পাশে কথা হয় কৃষক আবুল হোসেনের সঙ্গে। জানালেন শরীর ঘামছে সবসময়, কাজ করতে গেলে শরীর দুর্বল লাগে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টি না হলে খরা আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে। এখানকার মাটি আঠালো। পানির অভাবে মাটি শুকিয়ে শক্ত কাঠ হয়ে গেছে।
রাজশাহী বিভাগের পাবনা জেলায় বেশিরভাগ নদী গেছে শুকিয়ে। এরমধ্যে পদ্মা, যমুনা, কাগেশ্বরী, সুতিয়ালী, বান্নাই, চন্দ্রবতী, বড়াল, হুরা সাগর, রতনাই, ইছামতি, আত্রাই, গুমানীসহ আরও অনেক নদী রয়েছে।
পরিবেশবিদ তুহিন ওয়াদুদ জানান, রংপুর বিভাগেও বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সব নদ-নদীই এখন পানিশূন্য। আগে এসব নদীতে কিছুটা হলেও পানি থাকতো। খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্রের এখন করুণ দশা। হেঁটে চরের ওপর দিয়ে পার হওয়া যায় তিস্তা। বুড়ি তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ফুলপুর, নীলকমল, রতনাই, করতোয়া, রণচণ্ডী, আত্রাই, মহানন্দাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানির প্রবাহ এখন নেই বললেই চলে। অথচ এসব নদীর ওপর ভরসা করেই চলে অনেক কৃষকের জীবন জীবিকা। যমুনেশ্বরী, ঢেপা, ইছামতী, ছোট যমুনা, ঘাঘট, আঁখিরা, হলহলিয়াসহ অন্যান্য নদ-নদীও এখন কোথাও নালা কিংবা খালে রূপ নিয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে তীব্র খরায় চরাঞ্চলের চিনা বাদাম, তিল, আম লিচুসহ বিভিন্ন গাছের ফল শুকিয়ে অসময়ে ঝরে যাচ্ছে। পানির স্তর অস্বাভাবিক ভাবে নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপ থেকেও পানি উঠছে না। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার দীর্ঘ খরায় হুমকির মুখে পড়তে পারে ফসল উৎপাদন। এতে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির পাশাপাশি পরিস্থিতি মোকাবিলা করাই হবে উত্তরের কৃষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
মিঠাপুকুরের কৃষক আক্কাস আলী বলেন, এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় চাষাবাদ করেছি। অথচ খরায় চোখের সামনে সেগুলো নষ্ট হচ্ছে। মাটিতে রস নেই। বৃষ্টিও হচ্ছে না। সেজন্য ভুট্টা গাছ থেকে পড়ে যাচ্ছে। মেশিনের পানি দিলে এক নিমিষেই মাটি শুষে নেয়। গাছের কোনো উন্নতি হয় না।
পাশের সবজিক্ষেতে কাজ করছিলেন হারেজ নামের আরেক কৃষক। তিনি বলেন, ‘যে ওষুধ দিচ্ছি, তাতে কাজ হচ্ছে না। ৫০টা বেগুন হলে তারমধ্যে ৪৫টাতেই পোকা। সেচের পানি মাটি ধরে রাখতে পারছে না। তীব্র তাপপ্রবাহে সবজি, ভুট্টাসহ অন্যন্য ফসলি জমিতে ঘন ঘন সেচ দিতে গিয়ে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। পোড়ামাকড়ও বেড়েছে আগের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। সবমিলিয়ে আমাদের দিশেহারা অবস্থা।’
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গত কয়েকবছর ধরেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে উত্তরাঞ্চলে। এবারও বৈশাখের শুরু থেকে চোখ রাঙাচ্ছে সূর্য। তাপমাত্রা ওঠানামা করছে ৩৯-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে। এতে মাঠে ফসল ফলানো নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।
কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. ইসমাইল হোসেন বলেন, ক্ষতি থেকে বাঁচতে ধানের গাছে গোড়ায় পানি দিতে হবে। পানির অভাবে ধান চিটা হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এখন চারদিকে রিং টাইপ গর্ত করে পানি দিতে পারলে ভালো। এছাড়া মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বালাইনাশক পানিতে মিশিয়ে পরিমাণমতো গাছের পাতায় ছিটানো গেলে কিছুটা হলেও রক্ষা মিলবে।
এমএইচ