‘ছেলে না মেয়ে? গর্ভের শিশুর লিঙ্গ প্রকাশ করা যাবে না’
Share on:
মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না বলে রায় দিয়েছে বাংলাদেশের হাইকোর্ট।
এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে আদালত দেশের হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো যাতে গর্ভাবস্থায় শিশুর লিঙ্গ পরিচয় শনাক্তকরণকে নিরুৎসাহিত করে এবং গাইডলাইন কঠোরভাবে অনুসরণ করে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে।
খবর বিবিসি বাংলার।
আদালতের এই রায়কে যুগান্তকারী বলছেন এর রিট আবেদনকারী আইনজীবি ইশরাত হাসান।
“এই রায়ের পর এখন আর দেশের কোন হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ল্যাবরেটরি কোনভাবেই অনাগত শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করতে পারবে না, অর্থাৎ সন্তানটি ছেলে না মেয়ে তা আর আগে থেকে জানার সুযোগ নেই,” বলেন তিনি।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর লিঙ্গ পরিচয় নিষিদ্ধ করার জন্য প্রথমে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান এই আইনজীবি।
কিন্তু তার জবাব না পেলে জনস্বার্থে রিট পিটিশন দাখিল করেন তিনি। যেটার শুনানি শেষে ২০২০ সালে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুল জারি করে গর্ভের শিশুর লিঙ্গ পরিচয় শনাক্ত রোধে নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ দেয়।
চার বছর ধরে সেই শুনানি চলছিল। এর মাঝেই গত ২৯শে জানুয়ারি গর্ভের শিশুর লিঙ্গ পরিচয় শনাক্ত রোধে একটি নীতিমালা তৈরি করে হাইকোর্টে জমা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
আর আজ এর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে হাইকোর্টের বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের এক দ্বৈত বেঞ্চ।
বাংলাদেশি বাবা বনাম জাপানি মা: কোন মেয়ে কার কাছে থাকবে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট
আইনজীবী ইশরাত হাসান তার রিটের কারণ হিসেবে বলেন দেশে এখনো অধিকাংশ মানুষ ছেলে সন্তান প্রত্যাশা করে এবং পারিবারিক ও সামাজিক প্রত্যাশা পূরণে মায়েরাও ছেলে সন্তান প্রত্যাশা করে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে যাদের এক বা একাধিক কন্যাসন্তান আছে তাদের মধ্যে ছেলে সন্তান নিয়ে একটা মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
“পরীক্ষার মাধ্যমে যখন গর্ভবতী নারী জানতে পারে তার পরবর্তী সন্তান মেয়ে হবে তখন পরবর্তীতে তিনি ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হন, যা থেকে মানসিক নির্যাতন এবং কখনো পরিবারের সদস্য দ্বারা শারিরীক নির্যাতনেরও শিকার হন। এতে গর্ভবতী মা ও শিশুর স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।”
এ রায় অমান্য করলে আদালত অবমাননার শাস্তি হবে বলে জানান ইশরাত হাসান। আর যে কেউ চাইলে এ রায় ধরে আইনগত ব্যবস্থাও নিতে পারবে বলে জানান তিনি।
এর আগে বিবিসির কাছে এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছিলেন এই আইনজীবি।
তিনি বলেন, “ঢাকার একটি ডায়াগনস্টিক ক্লিনিকে ২০১৮ সালে নিজের গর্ভজাত সন্তানের অবস্থা দেখতে আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে যাই। ওই রুমে থাকা অবস্থায় আরেকজন মহিলাকে আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হচ্ছিলো তখন।"
"তার সাথে থাকা মহিলা বারবারই সন্তান ছেলে না মেয়ে জানতে চাচ্ছিলো। যখন তাকে জানানো হয় মেয়ে, কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বাইরে চলে যান তিনি।”
ওই আইনজীবী জানান, ওই রুম থেকে বের হয়ে জানতে পারেন ওই ঘটনার আগেও গর্ভে কন্যা শিশু থাকায় বিক্ষুব্ধ হয়েছেন পরিবারের অন্যরা, এমন ঘটনা আগেও আরও অনেক ঘটেছে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আবেদন করা হয় বলে জানান তিনি।
এই রায়ের কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর “ন্যাশনাল গাইডলাইন রিগার্ডিং প্যারেন্টাল জেন্ডার সিলেকশন ইন বাংলাদেশ” নামে যে নীতিমালা করে সেখানে বলা হয়, ‘কোনও ব্যক্তি, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ল্যাবরেটরি কোনও লেখা বা চিহ্ন অথবা অন্য কোনও উপায়ে শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করতে পারবে না। এ বিষয়ে কোনও রকম বিজ্ঞাপন দেয়া যাবে না।’
"ডাক্তার, নার্স, পরিবার পরিকল্পনা-কর্মী, টেকনিশিয়ান কর্মীদের নেতিবাচক ফলাফল সম্পর্কে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় প্রশিক্ষণ দেবে। এছাড়া নৈতিকতা ও পেশাগত আচরণ বিষয়েও ট্রেনিং দেওয়া হবে।"
এই নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, "হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার-সহ মেডিকেল সেন্টারগুলো এই সংক্রান্ত সব ধরনের টেস্টের তথ্য সংরক্ষণ করে রাখবে।"
রায়ের পর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় আইনজীবি ইশরাত জানান, “এ রায়ে আরও বলা হয়েছে শিশুদের যেসব টেস্ট করা হচ্ছে, যেখানে পরিচয় প্রকাশের সুযোগ আছে সেগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মিত ডেটাবেজ আকারে লিপিবদ্ধ করবে ও তুলে ধরবে, এ রায় এভাবে চলমান থাকে।”
একইসাথে আদালত বলেছে, গর্ভবতী মা ও শিশুর কল্যাণের জন্য, বা অনাগত সন্তানের সুস্থতা জানতে আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা যেকোনো পরীক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু শুধু পেটে থাকা সন্তান ছেলে না মেয়ে তা জানার উদ্দেশ্যে ডাক্তারি পরীক্ষা বা ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্টে লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ কোনোভাবেই কাম্য নয়।