বিএনপি-জামায়াতের তিক্ততার কারণ মোটা দাগে ২টি
Share on:
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এ ঘটনার পর দেশে নতুন পরিস্থিতিতে বিএনপি-জামায়াতের সম্পকের্র দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে।
দুই দল থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়ে তারা এখন আর একই জোটে নেই। তাহলে জামায়ত কী চাইছে? আর বিএনপিই বা কী করবে?
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কারণে এখন আওয়ামী লীগ মাঠে নাই। নেতাকর্মীরা হয় পালিয়েছেন, নয় আত্মগোপনে আছেন। আবার কেউ কেউ আটক হয়েছেন। তাই রাজনীতির মাঠে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সেটাকে মাথায় রেখে একটি বড় শক্তি হিসাবে সামনে আসতে চাইছে জামায়াত।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার একটি দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আমরা এই মুহূর্তে আমরা আর জোটবদ্ধ নাই। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যে জোট ছিল, আন্দোলনের জন্য জোট, সেটা অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে।এটা এখন কোনো কাজ করে না।’
এর একদিন পর শুক্রবার নরসিংদী শিশু একাডেমি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেলারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বাস্তবে কোনো দলীয় জোট নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত আন্দোলনে বিএনপি থেকে জোট না থাকার ঘোষণা দিয়েছেন তাদের দলীয় নেতারা। তাই তাদের সঙ্গে এখন আমাদের কোনো দলীয় জোট নেই। তবে পারস্পরিক সম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় আছে, থাকবে এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, এটা দল রক্ষা করে চলব।
তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে বসা হয় এবং দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে।’
বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এটা এখন স্পষ্ট যে তিক্ততার কারণ মোটা দাগে দুইটি।
১. বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইলেও জামায়াতের অবস্থান ভিন্ন। জামায়াত দ্রুত নির্বাচনের জন্য তাড়াহুড়ো না করে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে চায়।
২. জামায়াত আগামী নির্বাচনে বিএনপির বিপরীতে ইসলামি দলগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে শক্তি দেখাতে চায়।
আর জামায়াতের এই অবস্থানের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যদি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে তাহলে আরও চাপের মুখে পড়বে বিএনপি।
নির্বাচন যত দেরিতে হবে বিএনপি তত চাপে পড়বে। আর জামায়াত তত সুবিধাজনক অবস্থানে যাবে। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজনৈতিক দল সংগঠিত হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন হবে একটি কঠিন পরীক্ষার নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফলের জন্য বিএনপি সবসময়ই জনসমর্থনের ওপর নির্ভরশীল।’
জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান কয়েকদিন আগে বলেন, ‘একদিকে শহিদ পরিবারগুলো আহাজারি করছে। আহতরা হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বন্যার ভয়াবহতা শুরু হয়েছে।
যারা জনগণের জন্য রাজনীতি করে না তাদের উচিত এ বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এ সময়টা ওখানে না দাঁড়িয়ে নির্বাচন নির্বাচন জিকির করলে জাতি এটাকে কবুল করবে?’
জাময়াতের আমিরের এই কথার জবাবও দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি ২৮ আগস্ট জামায়াতকে লক্ষ্য করে বলেন, যাদের জনসমর্থন নেই, জনগণ মনে করে না যে এরা সরকার চালাতে পারবে, তারা এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা করে।
সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে, আমাদের লড়াইটা গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। সেটার জন্যই তো নির্বাচন। এটা তো আমাদের অধিকার। আমরা তো নির্বাচনের জন্যই এতদিন লড়াই করেছি, সংগ্রাম করে এসেছি।
জামায়াতের বেশি মিডিয়া কাভারেজেরও সমালোচনা করেন তিনি। আশঙ্কা প্রকাশ করেন এক এগারোর মতো বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে।
জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ ডয়চে ভেলেকে বলেন, মাঠে অনেক রাজনৈতিক কথা হয় তাতে বিএনপির সঙ্গে আমাদের কোনো দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে মনে করিনা। আমাদের পারস্পরিক সব দলই সংস্কার চায়।
আর আমরা সংস্কারের জন্য কোনো সময় বেঁধে দিতে চাই না। আমাদের পাস্পরিক সম্পর্কে কোনো ঘাটতি হয়েছে বলে মনে করি না। তবে এখন আমরা আর বিএনপির সঙ্গে জোটভুক্ত নাই।
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা ইসলামি দল ও সংগঠনের সঙ্গে এখন আলাপ আলোচনা করছি সবাই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য। কারণ বিগত ১৫ বছর আমরা অনেক নির্যাতন দমনের শিকার হয়েছি। নির্বাচন নিয়ে কোনো জোট করার জন্য এটা আমরা করছি না।
তার কথায়, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর আমরা ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে কোনো জোট করব কি না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। আর বিএনপির ব্যাপারেও আমাদের একই অবস্থান। এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। দেশে নতুন কোনো রাজনৈতিক দল হলে আমরা স্বাগত জানাই। কারণ গণতন্ত্রে রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, জামায়াত নেতারা অতি আবেগে অনেক কথা বলে ফেলছেন। তারা মনে করছেন নির্বাচন দেরি হলে হয়তো তাদের লাভ হবে। আমরা তো প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন চাই। বিএনপি জনপ্রিয় দল বলেই তো নির্বাচন চায়। যাদের জনপ্রিয়তা নাই তারাই নির্বাচন চায় না।
তার কথায়, জামায়াতের সঙ্গে আমাদের জোট ছিল স্বৈরাচারকে হটানোর জন্য। সেটা তো হয়েছে। এখন আর জামায়াতের সঙ্গে জোটের দরকার নেই। তাদের সঙ্গে আমাদের তো কোনো আদর্শিক জোট ছিল না।
তার কথায়, বিএনপি নতুন কোনো রাজনৈতিক দল নিয়ে ভীত নয়। সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে। এবি পার্টিও তো নিবন্ধন পেয়েছে। আরো অনেক দল পেতে পারে।’
আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ মনে করেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় জামায়াত সেই ফাঁকা জায়গায় একটি শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রকাশ করতে চাইছে। এই কারণেই তারা এখন বিএনপির বাইরে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে। নির্বাচন দেরিতে হলে তাদের শক্তি আরো সংহত হতে পারে।
তার কথায়, এতে ভোটের রাজনীতিতে বড় কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। কারণ তাদের যে ভোট ব্যাংক তা খুব বেশি বাড়বে না। কারণ বাংলাদেশের ভোট মূলত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। নির্বাচন দেরিতে হলেও আওয়ামী লীগ অল্প কিছু আসন পেতে পারে। কিন্তু তারা অনেক ভোট পাবে বলে আমি মনে করি। আর জামায়াত যদি ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট বেধে নির্বাচন করে তাহলে তাদের আসন কিছু বাড়বে।
তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন দল গঠন করলে তার দেন প্রভাব ভোটের রাজনীতিতে পড়বে না। কারণ বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতি আলাদা। তবে তাদের মানুষ স্বাগত জানাবে।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক দীর্ঘ সময়ের। এক সঙ্গে জোট বেধে আন্দোলন ও নির্বাচন সবই তারা করেছে। বিএনপি ও জামায়াত জোট একবার সরকারও গঠন করেছে।
সেই সরকারে জামায়াতের নেতারা মন্ত্রীও হয়েছে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তারা এখন দুই ভুবনের বাসিন্দা হতে চলছে।