প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের চার সদস্য গ্রেপ্তার
Share on:
রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তাররা পেশায় শিক্ষক, কম্পিউটার অপারেটর, সমাজসেবী এবং চতুর্থ জন একটি হত্যা মামলার আসামি বলে জানায় র্যাব। এই চার জন নানা সরকারি-বেসরকারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে এবং সমাধান দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিত।
বৃহস্পতিবার (১৯ মে) দুপুরে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে তাদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব। এসময় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আগামী ২০ মে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা রয়েছে বিধায় প্রতারক চক্রগুলো তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। র্যাবও এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ায়। এরই ফলশ্রুতিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূলহোতা মো. ইকবাল হোসেন ও তার তিন সহযোগী রমিজ মৃধা, মো. নজরুল ইসলাম, মো. মোদাচ্ছের হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, প্রথমে তারা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগ পরীক্ষা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। পরে ওই নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার স্থান ও পরীক্ষার গার্ড সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। এসময় চক্রের অন্য সদস্যরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি/বেসরকারি চাকরিপ্রত্যাশীদের খুঁজে বের করে ১০-১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় পাশ ও চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা বলে তাদের প্রলোভন দেখাত। আগ্রহী পরীক্ষার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলো দিয়ে এর ব্যবহার বিধি প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রাথমিকভাবে এক-দুই লাখ টাকা জামানত হিসেবে গ্রহণ করত। অবশিষ্ট টাকা চাকরি পাওয়ার পর পরিশোধ করবে মর্মে চুক্তি করত। এভাবে তারা বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তাররা জিজ্ঞাসাবাদে তাদের প্রতারণার কৌশল হিসেবে আরও জানায়, বিদেশ থেকে আনা এই ডিজিটাল ডিভাইসগুলো মূলত দুটি অংশে বিভক্ত। ডিভাইসটির একটি অংশ ইয়ার পিস তারা পরীক্ষার্থীদের কানের ভেতর এবং অটোমেটিক কল রিসিভ হওয়া সিম লাগানো অপর অংশটি শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে তাদের পরীক্ষার হলে প্রবেশ করাত। পরে পরীক্ষার্থীরা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ছবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের কাছে পাঠাত। প্রতারক চক্রটি প্রশ্নপত্রের উত্তর দেওয়ার জন্য আগে থেকেই মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি টিম প্রস্তুত রাখত। পরে চক্রের সদস্যরা পরীক্ষার হল থেকে পাঠানো প্রশ্নপত্রের উত্তর মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত টিমের মাধ্যমে খুঁজে বের করে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের বলে দিত।
র্যাব জানায়, প্রতারক চক্রটির মূলহোতা মো. ইকবাল হোসেন ২০০৮ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। সে নিজ এলাকায় শিক্ষকতা করার সময় ২০১৫ সালে একই এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী আলতাফ হোসেনের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে তার কাছ থেকে সরকারি/বেসরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের নিশ্চয়তা দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি রপ্ত করে। পরে করোনা মহামারির সময় আলতাফ হোসেন মারা গেলে গ্রেপ্তার ইকবাল হোসেন প্রতারক চক্রটি পরিচালনা শুরু করে। তার বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা ও বেশ কয়েকটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়েছে।
গ্রেপ্তার রমিজ এই প্রতারক চক্রের অন্যতম সহযোগী এবং একটি হত্যা মামলার পলাতক আসামি। গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে থাকাকালে ২০২০ সালে ইকবালের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে সময় রমিজ তার আর্থিক সংকটের কথা ইকবালকে খুলে বলে এবং বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস সম্পর্কে ভালো অভিজ্ঞতা আছে বলে জানায়। পরে ইকবাল বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় সহযোগিতা করার কথা বলে তাকে এই চক্রের সদস্য করে নেয়। ইকবালের ডিজিটাল ডিভাইস সম্পর্কে জ্ঞান কম থাকায় সে রমিজকে দিয়ে এ কাজ করাত বলে র্যাবকে জানায়।
গ্রেপ্তার রমিজ র্যাবকে আরও জানায়, যখন কোনো সরকারি নিয়োগ পরীক্ষা হতো তারা তখন পরীক্ষার্থীদের তাদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলো দিত। পরে পরীক্ষার সময় পরস্পর সংযুক্ত হয়ে তারা বাইরে অবস্থান করত এবং রমিজের পরিচিত কিছু মেধাবী ছাত্রের মাধ্যমে দ্রুত উত্তরপত্র তৈরি করে পরীক্ষার হলে ওই সব ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে জানিয়ে দিত।
গ্রেপ্তার নজরুল ১৯৯৪ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরে অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরিতে যোগ দেন। নজরুল এবং রমিজের বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় তারা একে অপরের পূর্বপরিচিত ছিল। চাকরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে নজরুলের। এ সুযোগে সে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে চাকরিপ্রার্থীদের ইকবাল ও রমিজের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিত বলে জানায় র্যাব।
নজরুল র্যাবকে জানায়, সে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার সময়, স্থান ও পরীক্ষায় গার্ড খুঁজে বের করার দায়িত্ব পালন করত।
গ্রেপ্তার মোদাচ্ছের মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার সমাজসেবা কার্যালয় থেকে সমাজসেবা কর্মী হিসেবে ২০১৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ইকবালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। তিনি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেওয়ার কথা বলে চাকরিপ্রার্থীদের খুঁজে বের করতেন। পরে ইকবাল ও রমিজের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ করিয়ে দিতেন। আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের আদালতে পাঠাবে র্যাব।
এমআই