tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
সারাদেশ প্রকাশনার সময়: ১৫ মে ২০২৪, ১১:০৩ এএম

শতবর্ষী অন্ধ মুয়াজ্জিনের মসজিদে যাওয়ার অবলম্বন বাঁশ ও দড়ি


blind-muazzin-story-20240515055422
শতবর্ষী অন্ধ মুয়াজ্জিন মো. আব্দুর রহমান মোল্লা। ছবি : সংগৃহীত

নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার নগর ইউনিয়নের বড়দেহা গ্রামের অন্ধ মুয়াজ্জিন মো. আব্দুর রহমান মোল্লা।


প্রায় ২০ বছর আগে এক দুর্ঘটনার পর ধীরে ধীরে দুই চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন। চোখের দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও মনের শক্তিতে এখনও মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। দেন নামাজের জন্য আজান। কখনোবা ইমামতির দায়িত্বও পালন করেন তিনি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত প্রায় ২০০ মিটার রাস্তার পাশ দিয়ে বাঁশ ও রশি টেনে নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার জন্য। মঙ্গলবার (১৪ মে) দুপুরে আব্দুর রহমান বাড়ি থেকে প্রতিদিনের মতো বের হন যোহরের নামাজের আজান ও নামাজ আদায়ের জন্য। লাঠির ওপর ভর করে বাড়ি থেকে বের হয়েই রশি ধরে ধরে মূল সড়কে ওঠেন। এরপর লাঠির সাহায্যে রাস্তা পার হয়ে বাঁশ আর দড়ি ধরে ধরে পৌঁছে যান মসজিদে।

পরিবার ও এলাকাবাসী জানায়, প্রায় ২০ বছর আগে একটি দুর্ঘটনার পর ধীরে ধীরে দুই চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন আব্দুর রহমান মোল্লা। অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ২০১১ সালে পবিত্র হজ পালন করে আসেন। এরপর গ্রামে নিজের পাঁচ শতাংশ জমির ওপর তৈরি করেন একটি পাকা মসজিদ। সেই মসজিদে গ্রামের মানুষ ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজের স্থাপন করা মসজিদে নামাজ আদায় শুরু করেন আব্দুর রহমান। মসজিদের মুয়াজ্জিন ও ইমাম হিসেবে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে দায়িত্ব পালন করছেন।

blind-muazzin-story1-20240515055151
শতবর্ষী অন্ধ মুয়াজ্জিন মো. আব্দুর রহমান মোল্লা। ছবি : সংগৃহীত

জানা গেছে, আব্দুর রহমানের ১৯ ছেলে-মেয়ে ও দুই স্ত্রী রয়েছেন। এর আগে ৬ মেয়ে মারা যায়। আব্দুর রহমানের বেশিরভাগ ছেলে মেয়েই উচ্চশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত। তার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শিক্ষক, কৃষি কর্মকর্তা, চিকিৎসক, বিজিবি সদস্য, ব্যবসায়ী। কেউবা আবার নিজেদের জমিজমা দেখাশোনা করেন।

আব্দুর রহমান মোল্লার ছেলে বরদেহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম সাইফুল।

তিনি বলেন, প্রায় ২০ বছর আগে একটি দুর্ঘটনাজনিত কারণে আমার বাবার চোখে সমস্যা হয়। ধীরে ধীরে তিনি অন্ধ হয়ে যান। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করেও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। পরে ২০১১ সালে বাবাকে নিয়ে হজ করে আসি। এরপর বাবার অর্থায়নে বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। সেখানে আমার পরিবার-পথচারী ও এলাকাবাসী নামাজ আদায় করেন।

তিনি বলেন, বাবার পরামর্শ অনুযায়ী প্রথম থেকেই বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত বাঁশ ও দড়ি টেনে দেওয়া হয়। প্রথমে কিছুদিন ছেলে ও নাতিরা বাঁশ ও দড়ি দেখিয়ে দিয়ে মসজিদ পর্যন্ত নিয়ে যেতেন। এখন মাঝেমধ্যে নাতিরা মসজিদে নিয়ে গেলেও বেশিরভাগ সময় একা একাই মসজিদে যান বাবা। এ বয়সেও বাবা মসজিদে গিয়ে আজান দেন এবং নামাজ আদায় করেন, এটাই অনেক বড় পাওয়া।

blind-muazzin-abdur-rahman-20240515055248
শতবর্ষী অন্ধ মুয়াজ্জিন মো. আব্দুর রহমান মোল্লা। ছবি : সংগৃহীত

আব্দুর রহমান মোল্লার ছোট ছেলে মো. সাগর হোসেন ইসরাফিল বলেন, এত বয়স হলেও আমার বাবা মসজিদে গিয়ে আজান দেন এবং ইমামতি করেন। এটা দেখে আমাদের বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চাও মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করে। তিনি বলেন, বাড়ি থেকে বাবার মূল সড়ক পর্যন্ত যেতে তেমন সমস্যা না হলেও পাকা সড়ক পার হতে সমস্যা হয়। কেননা অনেক গাড়ি চলাচল করে সেখানে। এলাকার ছোট ছোট গাড়ি চালকদের বলা হয়েছে মসজিদের সামনে আসলে গাড়ি যাতে ধীরে চালিয়ে যায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আব্দুর রহমানের এই ঘটনা দেখে রাজশাহী থেকে এদিন তার বাড়িতে দেখা করতে আসেন মো. ফাজ্জাহ নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, বাড়ি থেকে বের হয়ে দৃষ্টিহীন আব্দুর রহমান কারোও সহযোগিতা ছাড়াই দড়ি ও বাঁশ ধরে মসজিদে গিয়ে আজান দেন এবং নামাজ আদায় করেন। তার পেছনে আমিও নামাজ আদায় করেছি। আমি সত্যিই অভিভূত।

এ ব্যাপারে মুয়াজ্জিন আব্দুর রহমান বলেন, ১০ কাটা জমি বিক্রি করে সেই অর্থে মসজিদটি নির্মাণ করেছি। আল্লাহ যাতে মসজিদটিকে কবুল করেন এবং পরিবার-পরিজনসহ সবাইকে হেদায়েত দান করেন। আমি অন্ধ মানুষ, মসজিদে যাওয়া-আসা করে আনন্দ পাই। সকলেই যাতে মসজিদে এসে নামাজ পড়ে।

তিনি বলেন, এখন টিউবওয়েলে পানি না ওঠায় অন্য মানুষদের ওজু করতে সমস্যা হয়, মসজিদের পাশে একটা পানির পাম্পের ব্যবস্থা হলে খুব ভালো হতো। আমি প্রাণ ভরে দোয়া করতাম।

পার্শ্ববর্তী আরেক মসজিদের ইমাম মো. রমজান আলী নাটোরী বলেন, হযরত আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদিসে এসেছে, উম্মে মাকতুম (রা:) নামে মহানবী (সা:) এর এক সাহাবী অন্ধ ছিলেন। ওই সাহাবী যাতে মসজিদে যেতে পারেন সেজন্য বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত দড়ি টেনে দেওয়া হয়েছিল। ওই সাহাবীকে অনুকরণ করে এই বৃদ্ধ এভাবে মসজিদে আসেন, এটা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আব্দুর রহমান মুসলমানদের জন্য অনুপ্রেরণা। আল্লাহর ফরজ বিধান প্রতিপালনে শতবর্ষী এই বৃদ্ধের চেষ্টা অন্যদের জন্যও অনুকরণীয়।

এনএইচ