tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
প্রকাশনার সময়: ০৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪:১৪ পিএম

বুয়েট ছাত্র আবরারের পরিচয়, যেভাবে হত্যা করা হয়েছিলো


আবরার.jpg

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট তৎকালীন ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী।


বুয়েট.jpg

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী।

চকবাজার মডেল থানা.jpg

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ পরদিন চকবাজার থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, শিবির সন্দেহে তাকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে মেরেছে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

সেই মামলায় বুয়েট ছাত্রলীগের ১৯ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়।

গোয়েন্দা পুলিশ.jpg

মামলার তদন্তের পর ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, আসামিরা র‍্যাগিংয়ের নামে বুয়েটে আতংক বা একটা ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তার ধারাবাহিকতাতেই একাধিক কারণে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে।

Kustia.jpg

আবরার ফাহাদ ১৯৯৮ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায়। তার বাবার নাম মো. বরকত উল্লাহ এবং মায়ের নাম রোকেয়া খাতুন।

কুষ্টিয়া মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয় .jpg

তিনি কুষ্টিয়া মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন।

কুষ্টিয়া জেলা স্কুল .jpg

পরে কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে পড়াশোনা করেন।

Notordem-collage.jpg

পরবর্তীতে তিনি নটর ডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছেন।

২০১৮ সালের ৩১ মার্চ আবরার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন।

Brac.jpg

আবরার বাবা বরকতউল্লাহ ব্র্যাকে অডিটর এবং মা রোকেয়া খাতুন কিন্ডারগার্ডেনের শিক্ষক ছিলেন।

আবরার দুই ভাইয়ের বড় ছিল, তার ছোট ভাই আবরার ফায়াজ ঢাকা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এইচএসসি ছাত্র ছিল। ফায়াজ শের-ই-বাংলা হলের নিকটবর্তী ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাসে থাকতেন।

বুয়েটে সেদিন রাতে যা ঘটেছিলো

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

মারধরের একপর্যায়ে আবরার বমি করে দেন, প্রস্রাবও করে ফেলেন। পরে তাকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে এনে পোশাক বদলে ফের মারধর করা হয়।

কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলা আবরার ইঙ্গিতে তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিতে বারবার মিনতি করলেও তাতে কান দেননি বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। শেষ পর্যন্ত আবরারকে মেরে ফেলার পরই ক্ষান্ত হন তারা।

আবরার ফাহাদকে হত্যার এমন নৃশংস বর্ণনা উঠে এসেছে পুলিশের দাখিল করা চার্জশিটে।

চার্জশিটে আবরার হত্যার মূল হোতা এবং আবরারকে মারধরের ঘটনার সূচনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারভুক্ত আসামি মিজানুর রহমান ওরফে মিজানকে। তিনি আবরারের রুমমেট ছিলেন।

চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে, ৪ অক্টোবরের আগের কোনো একদিন তিনি এজাহারভুক্ত আরেক আসামি মেহেদী হাসান রবিনকে জানান, আবরারকে তার শিবির বলে সন্দেহ হয়।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে রবিন ‘এসবিএইচএসএল ১৫’ ও ‘এসবিএইচএসএল ১৬’ গ্রুপের সবাইকে ফেসবুকে মেসেজ দেন এবং ৪ অক্টোবর রবিন ও মুন্নার নেতৃত্বে অমিত সাহা, সকাল, আকাশ, তাবাখখারুল, মনির, জিয়নসহ অন্য আসামিদের উপস্থিতিতে বৈঠক হয়।

ওই সময় আবরার গ্রামের বাড়িতে থাকায় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, পরদিন আসামি মনিরের নেতৃত্বে তোহা, আকাশ, মাজেদ, মোর্শেদ, মোয়াজসহ অন্যরা গেস্ট রুমে আবরারকে পেটাবে।

এরপর গত ৬ অক্টোবর মুজতবা রাফিদ তার সহযোগী সকাল ও রবিনকে জানান, তিনি বাড়ি যাবেন। আবরারকে ধরলে ওই দিনই ধরতে হবে। কিছুক্ষণ পর সকালকে তোহা ও রাফাত জানান, আবরার বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে।

এরপরই আসামিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে রাত ৮টার পর শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর রুমে একত্রিত হন।

সেখান থেকে রবিন ও সকালের নির্দেশে তানিম, জেমি ও সাদাত ১০১১ নম্বর রুমে গিয়ে আবরারকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন।

বলেন, তাকে ২০১১ নম্বর রুমে বড় ভাইরা ডেকেছেন। পরে আবরারকে তার ল্যাপটপ ও দুইটি মোবাইলসহ ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে যান তারা।

চার্জশিটে বলা হয়েছে, আবরারকে ২০১১ নম্বর রুমে নেওয়ার পরই তাবাখখারুল, সকাল ও রাফিদ তার মোবাইল ও ল্যাপটপ পরীক্ষা করতে থাকেন।

তারা বলেন, আবরারের মোবাইলে ছাত্রশিবির সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে। এটা শুনেই আবরারকে চশমা হাতে নিতে বলেন রবিন এবং আবরার তার চশমা হাতে নিলে রবিন তাকে চড় মারতে শুরু করেন।

এর পরপরই মোর্শেদ কাঠের ক্রিকেট স্টাম্প নিয়ে এলে সকাল সেটা দিয়ে আবরারের পিঠ, পা, হাত ও নিতম্বসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে নির্মমভাবে আঘাত করতে শুরু করেন।

এসময় সকালের হাতের স্টাম্পটি ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেলে এহতেশামুল রাব্বি তানিম আরেকটি স্টাম্প নিয়ে আসে। অনিক সরকার সেটা দিয়ে আবরারের শরীরে একটানা আঘাত করতে থাকে।

টানা মারধরে আবরার ফাহাদ রুমের মেঝেতে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম ও শামীম বিল্লাহ স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরার ফাহাদকে দুই থেকে তিনটি আঘাত করে, স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরার ফাহাদের পিঠ ও পায়ে আঘাত করতে শুরু করেন।

আবরার তাকে মারধর না করার জন্য আকুতি জানালেও পরে মেফতাহুল ইসলাম জিয়নও স্টাম্প দিয়ে আবরারকে মারতে থাকেন এবং জিজ্ঞাসা করেন, আবরার ছাত্রশিবির করেন কি না।

রাত ১১টার পর এস এম সেতু ২০১১ নম্বর রুমে এসে অন্যদের আবরার ফাহাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

এসময় অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল ও মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, সে (আবরার) কোনো তথ্য দিচ্ছে না। তখন সেতু অন্যদের বলেন, ‘মারতে থাক।’

ওই নির্দেশের পর আবরারকে আরও বেশি মাত্রায় পেটানো শুরু হয়। স্টাম্প দিয়ে আঘাত করা ছাড়াও তারা আবরারের পুরো শরীরে কিল-ঘুষি, লাথি মারতে থাকে।

আসামি মেহেদি হাসান রবিন ও অনিক সরকার রুম থেকে বের হওয়ার সময় উপস্থিত অন্যদের বলেন, ‘তোরা ওর (আবরার) কাছ থেকে তথ্য বের কর।’

এ সময় আসামি আবরারের মোবাইল চেক করে ছাত্রশিবিরের তথ্য পাওয়া গেছে বলে আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারকে আঘাত করেন মনিরুজ্জামান মনির।

উপস্থিত অন্য আসামিরাও আবরারকে প্রচণ্ড মারধর করতে থাকেন। একপর্যায়ে আবরার ফাহাদ বমি ও প্রস্রাব করে দেন। কথা বলতে না পারলেও ইশায় তাকে প্রাণে বাঁচতে আর মারধর না করতে অনুরোধ করেন।

কিন্তু আসামিরা আবরারকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে পোশাক বদলে দেন।

আবরার.jpg

এসময় ইফতি মোশারফ সকাল ও মেহেদী হাসান রবিনের হুকুমে এ এস এম নাজমুস সাদাত, শামীম বিল্লাহ, আকাশ হোসেন, আবু হুরাইরা মোয়াজ, জেমিসহ আরও কয়েকজন আবরার নিথর দেহ ধরাধরি করে ২০০৫ নম্বর রুমে নিয়ে যান এবং জাহিদ হাসান জনিকে ডেকে মোশাররফ সকাল ২০১১ রুম পরিষ্কার করিয়ে নেন।

এদিকে, আবরার ফাহাদকে ২০০৫ নম্বর রুমে নেওয়ার পর আবরারকে জেরা করা শুরু হয়, বুয়েটে কে কে ছাত্রশিবির করে।

কিন্তু আবরার তখন প্রায় সংজ্ঞাহীন। এসময় রবিনকে আবু হুরাইরা, অমর্ত্য ইসলাম, মেহেদী হাসান বলেন, আবরারকে হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু রবিন বলেন, ও (আবরার) নাটক করছে।

শিবির চেনস না, শিবির চেনা কষ্ট। পরে আরও মারধরের পর ৬ অক্টোবর দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে মুয়াজ আবু হুরায়রা ওরফে মোয়াজ, ইফতি মোশারফ সকাল, মুজাহিদুল ইসলাম, খন্দকার তাবাককারুল ইসলাম তানভীর ও হোসেন মোহাম্মদ তোহা একটি তোষকে করে আবরারকে রুম থেকে বের করে নিয়ে দ্বিতীয় তলায় ওঠার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে রেখে দেন।

চার্জশিটে বলা হয়, এর মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আবরার। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আসামিরা আবরারকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য বুয়েটের চিকিৎসক ও অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন। চিকিৎসক এসে আবরারকে মৃত ঘোষণা করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটে উল্লেখ করেছেন, আসামিরা যোগসাজশে একে অন্যের সহায়তায় ছাত্রশিবির সন্দেহে আবরারের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে তাকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছেন।

তাকে হত্যার পর তারা মামলার আলামত ক্রিকেট স্টাম্প, তোষক, বালিশ, ল্যাপটপ-মোবাইল ও স্টিলের পুরাতন চাপাতি শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর রুম থেকে এবং সিঁড়ি ল্যান্ডিং স্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে একই হলের ২০১০ নম্বর রুমে রেখে দেন। ওই রুমে থাকতেন আরেক আসামি মুহতাসিন ফুয়াদ।

আবরার হত্যা মামলার আসামী.jpg

দুই বছরের পর আজ আবরার হত্যা মামলার রায় দেয়া হয়। রায়ে ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবনের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

আজ বুধবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।

এইচএন