tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
মতামত প্রকাশনার সময়: ০৪ জুলাই ২০২২, ০৯:৫০ এএম

আপাতত টিকা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে


Covid19-2022

ডা. মুশতাক হোসেন : কয়েকদিনের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, করোনার সংক্রমণ আবার বাড়ছে। মাঝখানে কিছুদিন আমাদের দেশ মৃত্যুশূন্য দিন পার করলেও এখন আবার মৃত্যুও হচ্ছে। এটা এখনও সিঙ্গেল ডিজিটে আছে; ডাবল ডিজিটে চলে যেতে পারে। করোনায় এক দিনে ২৬৪ জনের প্রাণহানি হয়েছে। তাই সংক্রমণের এ ঊর্ধ্বগতিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। সরকার যে ৬টি নির্দেশনা দিয়েছে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু আমরা কী দেখি; কার্যত কম লোকই এসব স্বাস্থ্যবিধি মানে।


জুলাইতে যে সংক্রমণটি আসতে যাচ্ছে এটিকে বলা হচ্ছে করোনার চতুর্থ ঢেউ। আমার দৃষ্টিতে এটি পঞ্চম ঢেউ। চতুর্থ-পঞ্চম যাই হোক, এবারের সংক্রমণটি দ্রুতই উঠছে। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দ্রুত উঠলে দ্রুত নেমে যায়। হয়তো এবারের ঢেউটি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে প্রাণহানি ও সংক্রমণ বেশি হতে পারে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। একইসঙ্গে বদ্ধ স্থানের পরিবর্তে খোলামেলা জায়গায় থাকতে হবে।

অনেক সময় আমরা বদ্ধ ঘরে গান-বাজনা করে থাকি। এসব কারণে দ্রুত ভাইরাসটি একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। করোনাভাইরাস ভারী হওয়ায় ১ মিটারের বেশি উড়তে পারে না। ফলে সামাজিক দূরত্ব মেনে চললে ও মাস্ক পরলে এটিতে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। কিন্তু এ নীতি বদ্ধ ঘরে প্রযোজ্য নয়। কারণ বদ্ধ ঘরে ঘনত্ব বেড়ে আরও দূরে গিয়ে এটি সংক্রমিত করার ক্ষমতা রাখে। এ কারণে যতটা সম্ভব বদ্ধ ঘরের পরিবর্তে খোলামেলা জায়গায় থাকতে হবে। আমাদের দেশে গরমকালে ঘরে এসি চালানো হয়। শীতপ্রধান দেশে হিটার চালানো হয়। বদ্ধ ঘরে এসি ও হিটার উভয়ই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।

হাসপাতাল, করোনা পরীক্ষা কেন্দ্র ও টিকাদান কেন্দ্রগুলো সাধারণত বদ্ধ স্থানে হয়ে থাকে। স্বাভাবিক কারণে এসব স্থানে অসুস্থ মানুষের আসা-যাওয়াই বেশি থাকে। ফলে এসব স্থানে সুস্থ মানুষ গেলেও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই করোনা পরীক্ষা কেন্দ্র ও টিকাদান কেন্দ্র খোলা স্থানে করতে হবে। একই সঙ্গে হাসপাতালের জানালা খোলা রাখতে হবে। যেন পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ঢুকতে পারে। এতে হয়তো কিছু বেশি টাকা খরচ হবে, কিন্তু ঝুঁকি কমবে। বাসা-বাড়ির ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করতে হবে। অফিস, রেস্টুরেন্ট, ব্যাংক- এসব বদ্ধ স্থানে যতটা কম থাকা যায় ততই নিরাপদ। তবে চাকরি ও প্রয়োজনের তাগিদে এসব একেবারে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে এসব স্থানে ভেন্টিলেটর নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারিভাবে যে ৬টি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, তা যথার্থ। বিধিনিষেধ কিন্তু আগেও ছিল। মাস্ক পরতে হবে- এ নির্দেশনা নিশ্চয়ই নতুন করে দেওয়ার কথা নয়। এটা করোনার শুরু থেকেই বলবৎ রয়েছে। কিন্তু আমরা মানছি না। যখনই সংক্রমণ কম দেখি তখনই মাস্ক পরা ছেড়ে দিই। মাস্ক পরে যদি ভিড়ের মধ্যে যেতে হয় তাহলে ফল আসবে না। এসব ভিড় আমরা চাইলেই পরিহার করতে পারব না। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক উদ্যোগ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দরকার হবে। কারণ সভা-সমাবেশ, মিছিল এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যতটা সম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে।

টিকার ব্যাপারে আগে যতটা আগ্রহ দেখা গেছে, এখন কিন্তু ততটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশের ১২ কোটি ৯ লাখের বেশি মানুষ টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১১ কোটি ৯৩ লাখের বেশি। কিন্তু তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার নিয়েছেন ২ কোটি ৯০ লাখের কাছাকাছি। তার মানে বুস্টার ডোজে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। কিন্তু আসন্ন ঢেউ মোকাবিলা করতে হলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে যাঁদের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ৪ মাস পূর্ণ হয়েছে তাঁদের বুস্টার ডোজের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

দেশে যাঁরা এখনও একটি ডোজও নেননি বা পাননি তাঁদের টিকাদানে উদ্যোগ নিতে হবে। টিকার কার্যকারিতা ৩ মাস। এটি শরীরে অনেকদিন ধরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ালেও ৩ মাস পর এটির শক্তি কমে যায়। তাই প্রতি ৪ মাস পর পর টিকা দেওয়া দরকার হতে পারে। হয়তো সিদ্ধান্ত আসতে পারে, যারা বুস্টার ডোজ গ্রহণ করেছেন তাঁদের চতুর্থ ডোজ দেওয়া হবে। এখনও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৬ শতাংশ জনগোষ্ঠী বুস্টার ডোজের বাইরে। এটা ভালো সংবাদ নয়। সংক্রমণ কমে যাওয়ায় উদাসীনতা থেকে অনেকে টিকা নিচ্ছেন না।

সরকারিভাবেও জোরালো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় এখন হয়তো তোড়জোড় শুরু হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে; এই বৈশ্বিক মহামারি থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে নিজের তাগিদেই সচেতন হতে হবে। করোনায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে, যাদের বয়স ৫০-৫৫ এর বেশি এবং যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে রয়েছে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, যক্ষ্ণা, কিডনি, হৃদরোগ ইত্যাদি। আরও ঝুঁকিতে রয়েছেন সম্মুখযোদ্ধারা। অর্থাৎ চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সংবাদকর্মী।

এসব মানুষকে কতটুকু টিকার আওতায় আনা গেছে; সেটা কিন্তু ভাবার বিষয়। কারণ দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্তদের যদি বুস্টার ডোজের আওতায় আনা না যায় তাহলে এ ঢেউয়ে তাঁদের বড় একটি অংশের প্রাণহানি ঘটতে পারে। এখন যাঁরা যুবক ও সুস্থ তাঁদের বুস্টারের আওতায় এনে পরিসংখ্যানে সাফল্য দেখানো যাবে। কিন্তু যদি জটিল রোগী, বয়স্ক ও সম্মুখযোদ্ধারা বাদ পড়ে থাকেন তাহলে তাঁদের জন্য আসন্ন ঢেউ বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই এসব মানুষকে শনাক্ত করে যত দ্রুত সম্ভব টিকা দিতে হবে।

চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ৭০-৮০ ভাগ মানুষকে করোনার টিকার আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু সেখানে অনেক লোক মারা যাচ্ছে। এর কারণ তারা জটিল রোগী ও বয়স্কদের টিকা শতভাগ নিশ্চিত করতে পারেনি। ওমিক্রনের শাখা-প্রশাখা যেগুলো নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে তারা কিছু মানছে না। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও টিকা নিশ্চিত করেই আমাদের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। এখন পর্যন্ত বাজারে যেসব টিকা রয়েছে এগুলো স্থায়ী কার্যকারিতা না দিলেও অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আরও নতুন সংস্করণ বের হবে।

সেসব টিকা গ্রহণ করলে স্থায়ী ফল পাওয়া যেতে পারে। আপাতত ৪ মাস পর পর এসব টিকা নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হতে পারে। টিকার সংকট নেই; বাণিজ্যিক কারণে কিছু কিছু দেশ টিকার সংকট তৈরি করে রাখলেও সেটা কেটে যাচ্ছে। তাই যদি ৩-৪ মাস পর পর টিকা দেওয়ার নির্দেশনা আসে তখন টিকার সংকট হবে না। টিকা ছাড়া ওমিক্রনের শাখা-প্রশাখার সংক্রমণ ঠেকানো যাবে না।

লেখক : রোগতত্ত্ববিদ; সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)

এইচএন