‘আর পারতাছি না বাবা, বিছনা পাতি দেও ঘুমামু’
Share on:
রাজধানীর বনানীর গোডাউন বস্তিতে ঢোকার মুখে কর্দমাক্ত রাস্তা মাড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে যেতে দেখা যায় আব্দুর রউফকে। পাশ দিয়ে যাবার পথেই কানে ভেসে আসে কোলে থাকা শিশুর করুন আবেদন, ‘বাবা বিছনা পাতি দেও, ঘুমামু!’
ছোট্ট তাসলিমার এমন আবেদনে বাবা হিসেবে বিদীর্ণ হবার দশা আব্দুর রউফের হৃদয়। তাসলিমার ওই হৃদয় বিদীর্ণ করা কথার পরেই ঘুরে রউফকে অনুসরণ করি ক্ষণিক পথ। দেখা যায়, চোখ মুছতে মুছতে রউফ দ্রুত পা স্থির করেন। যেন তার চোখ খুঁজছিল আশপাশে আগুন থেকে অক্ষত থাকা কোনো প্রতিবেশীর ঘর, যেখানে শিশু তাসলিমার ঘুমের বন্দোবস্ত করা যায়।
পেশায় ফেরি করে কসমেটিকস দোকানি আব্দুর রউফ বলেন, আগুনের সময় ঘরেই ছিলাম, দুই কন্যা বাইরে ছিল। আমি ঘরে থাকলে তাসলিমা দিনে ঘুমায় না। খেলে, হাসে আর কোলে উঠে৷ তাসলিমাকে নিয়ে বিছানায় শুয়েই ছিলাম, বাতাস বইছিল, একটু পর আগুন আগুন চিৎকার। তাসলিমাকে কোনো রকমে কোলে নিয়ে যখন ঘর থেকে বের হইছি ততোক্ষণে আগুন চলে আসছে পাশের ঘরে।
বাবা আব্দুর রউফ বলেন, আগুনের লেলিহান শিখা আর পুড়তে থাকা ঘর দেখে তাসলিমা আর রাতে ঘুমাতে পারেনি। নির্ঘুম রাত কাটানো তাসলিমা এখন ক্লান্ত, খুঁজছে বিছনা, যেখানে শুয়ে একটু ঘুমাতে চায়। ওরে কেমনে বুঝাই আগুনে আমার সব তো পুড়ে ছাই।
এর আগে, রোববার (২৪ মার্চ) বিকেল ৪টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয় বনানীর গোডাউন বস্তিতে। সোয়া ৪টায় ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। কিন্তু আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকায় পরবর্তীতে আরও ৭টি ইউনিট গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ কাজে যোগ দেয়। বাতাসে যেমন আগুনের তীব্রতা বেড়েছে তেমনি ঝুম বৃষ্টির কারণে মোট ১০টি ইউনিটের দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সহজ হয় ফায়ার সার্ভিসের। বিকেল সাড়ে ৫টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
এদিকে কিছু বুঝে উঠার আগেই আগুনে গোডাউন বস্তির অন্তত দুই শতাধিক বাসিন্দা হারিয়েছেন ঘর। অধিকাংশরাই ঘর থেকে বেড়িয়েছেন এক কাপড়ে। আগুনে সব কিছু পুড়ে যাওয়ায় ধ্বংসস্তূপের উপর খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করতে হয় তাদের।
মিলি আক্তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। গত ১২ বছর যাবত গোডাউন বস্তিতে বসবাস করা মিলির স্বামী রফিকুল ইসলাম রিকশা চালক।
বাসা বাড়িতে বুয়ার কাজ করা মিলি বলেন, আমি কাজে ছিলাম, স্বামী খ্যাপ নিয়া গেছিল বসুন্ধরায়। খবর পায়া ছুটে আইসা দেখি ঘরে দ্বোরে (সামনে) আগুন। নিজের পরনের কাপড় ছাড়া কাঁথা কম্বল, হাড়ি পাতিল, টিভি ফ্রিজ কিছুই বের করতে পারিনি। গত রাতেও এক লগে সবাই ঘুমাইছি। গেলো রাত কাটলো খোলা আকাশের নিচে। নিঃস্ব হয়া (হয়ে) গেছি ভাই৷ সব শেষ।
আগুন নিঃস্ব হওয়া আরেক বাসিন্দা রেহানা আক্তার বলেন, গোসল করতে গেছি। আসার সময় শুনি আগুন। ওই যে দেখতাছেন, দ্বোতলা ঘর ওইহান থেকে আগুনটা লাগছে। কেমনে লাগছে জানিনা, বাতাসে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভেজা কাপড়ে ঘরে ফিইরা দেহি স্বামী মফিজ উদ্দিন। তারে ঘুম থেকে তুইলা রাস্তার ধারে যাই৷
রেহানা আক্তার বলেন, কি করতাম, কই যাইতাম, কিছু করবার তো পারি নাই। সব তো পুইড়া শেষ, এখন কি খামু, কই যামু! সাজানো ঘর আঙ্গার, এক আগুনে ছাদটা শূন্য হয়ে গেলো। পিন্দনের (পরনের) কাপড়টা ছাড়া কিচ্ছুই আর অবশিষ্ট নাই। বাচ্চাগুলার মুখের দিকে তাকাতে পারতাছি না, বই খাতাও পুড়ে গেছে, বের করতে পারিনি।
রেহানার স্বামী মফিজ উদ্দিন সিটি করপোরেশনে ময়লার কাজ করেন। তিনি বলেন, পা ভাঙছে তিনবার। কাজ আর আগের মতো করতে পারি না৷ তিনডা বাচ্চা নিয়া এখন কি করমু।
শামসুন্নাহার-কবির হোসেন দম্পতির দুঃখটা যেন আরও বেশি। দুমাস আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ঈদের পরেই মেয়েকে জামাইয়ের ঘরে তুলে দেওয়ার কথা ছিল।
কবির হোসেন বলেন, দুই ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে, ওখানেই থাকে। মেয়েকে বিয়ে দিছি। মেয়ের বিয়ের বিদায় অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিছি। আগুনে সব শেষ। বাচ্চাডার বিয়ের কাপড়, মেয়ের জন্য বানানো একটা চেইন, কানের জিনিস, বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য জমানো ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ছিল। কিচ্ছু নিতে পারি নাই।
শামসুন্নাহার বলেন, এখন কি করমু, পথে বসার দশা। মেয়েডার সংসারটা কেমনে কি করবো! জামাইয়ের ঘরে ওরে কেমনে ওডামু!
সংশ্লিষ্ট এলাকার ২০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নাছির বলেন, গোডাউন বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের দুঃখ কষ্টের কথা বিবেচনা করে আমরা রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করেছি টিএনটি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে৷ খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করছি।
আমরা এখন পর্যন্ত হিসেব করে জানতে পেরেছি সেখানে ২২০ থেকে ২২৫টি ঘর পুড়েছে। সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের জন্য ক্ষতিপূরণ বা আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এনএইচ