মামলার ভয় উপেক্ষা করে আন্দোলনে অনড় কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা
Share on:
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে মামলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। মামলা প্রত্যাহারে শিক্ষার্থীদের দেওয়া ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। তবে মামলা প্রত্যাহার হোক বা না হোক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, ভয় দেখানোর জন্যই তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলা তাদের আন্দোলন দমাতে পারবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কোটা আন্দোলনের নেতারা।
গত বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) বিকেলে শিক্ষার্থীদের অবরোধ ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে শাহবাগে অবস্থান নেয় পুলিশ। তারা সাঁজোয়া যান, জল কামান নিয়ে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে শিক্ষার্থীদের। তবে পুলিশের বাধা ভেঙেই শিক্ষার্থীরা শাহবাগে অবস্থান নেয়। ওই সময় কিছু শিক্ষার্থী পুলিশের সাঁজোয়া যান ও জলকামানে উঠে তা দখলে নেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে এই ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ওই দিনই রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পরিবহন বিভাগের গাড়িচালক খলিলুর রহমান বাদী হয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন। এতে পুলিশের একটি সাঁজোয়া যান এবং জল কামান ভাঙচুর করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়। অনির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থীকে মামলায় আসামি করা হয়।
তবে ভাঙচুরের অভিযোগ অস্বীকার করেন শিক্ষার্থীরা। শনিবার (১৩ জুলাই) এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ একটি কল রেকর্ড শোনান। সেখানে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়- শিক্ষার্থীরা ভাঙচুর করেনি, হয়তো কেউ কেউ গাড়ির উপর উঠে ছবি তুলেছে। কিন্তু ভাঙচুরের ঘটনা কোনোভাবেই ঘটেনি, এটা আপনাকে কনফার্ম করলাম।
জানা গেছে, ওই পুলিশ কর্মকর্তা রমনা থানায় কর্মরত। ওই কলটি ১১ জুলাই ঠিক সাঁজোয়া যান দখলের কিছুক্ষণ পরের।
কোটা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে যা আছে
একই সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ কার নামে মামলা দিচ্ছে তা আমরা জানতে চাই৷ আমরা নেতৃত্বে আছি, দরকার হলে আমাদের নামে দিক। 'অজ্ঞাতনামা অনেক শিক্ষার্থী' এইরকম ভাবে মামলা দেওয়া স্রেফ দমনের উদ্দেশ্যে।’
মামলা তুলে নিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মামলা তুলে নিতে হবে। না হলে আমরা আন্দোলন আরও বেগবান করবো। প্রয়োজনে গণআন্দোলন হবে। সকলের সাথে মিলে, সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে আমরা একটি গণআন্দোলন গড়ে তুলব।’
মামলা নিয়ে কী বলছেন শিক্ষার্থীরা
চলমান কোটা আন্দোলনের সম্মুখ সারির নেতা হাসানাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘দেখুন, আমরা রেকর্ডটি শোনানোর পর এটা নিয়ে আর কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না যে, আন্দোলন দমনের জন্যই মামলাটি করা হয়েছে।’
ইসফার সারাওয়াত নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এটা মেনে নেওয়ার মতো নয়। যেটা নির্দিষ্ট কারো ওপর করুক অথবা অনির্দিষ্ট কারো ওপর মামলা করুক। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আটক করা হলে আন্দোলন আরও বেগবান হবে। কেউ বসে থাকবে না তখন। কোনো শিক্ষার্থীকে আটক করে এখন পর্যন্ত কোনো আন্দোলন ব্যর্থ করা যায়নি, এবারও হবে না ইনশাআল্লাহ।’
ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ রাফি বলেন, ‘এটি অন্যায়, আন্দোলন বন্ধ করার বিশ্রী প্রচেষ্টা।’
একই বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ‘কোটা আন্দোলনে গিয়েছি। পুলিশ আমাদের নামে মামলা দিয়েছে জানলাম। তবে এখনো বুঝতে পারছি না আসলে বিষয়টি কোন দিকে যাবে। তবে কোনো ভয়ভীতি কাজ করছে না।’
সমাজকর্ম ও গবেষণা বিভাগের শিক্ষার্থী আইয়ুব আল আরাবী বলেন, ‘পুলিশের মামলা বিষয়ে আমি বলতে চাই, মামলাটি নিছক ভিত্তিহীন। পুলিশকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরাসরি গিয়ে মারেনি, পুলিশ যখন শিক্ষার্থীদের ওপর চলে আসে তখনই হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়, এখানে স্পষ্ট কোনো শিক্ষার্থীর দোষ নেই। এখন যদি পুলিশ কোনো শিক্ষার্থীকে এ মামলায় আসামি হিসেবে ধরে নেয়, তাহলে সকল শিক্ষার্থী এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে।’
মনোবিজ্ঞান বিভাগের মাহিয়ান ফারদিন সিফাত বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমন করার জন্যই মামলা করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দর্শন বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘পুলিশের এমন কর্মকাণ্ড দেখে হিটলারের গেস্টাপো পুলিশ বাহিনীর কথা মনে পড়ছে। নাৎসি বাহিনীর নৃশংসতা দ্বারা যেন আমাদের দমন করতে চাইছে।’
আব্দুল আজিজ আরিফ নামের প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন ডিপার্টমেন্টের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রথম প্রশ্ন, পুলিশ কেন মামলা করবে? পুলিশের কোনো কাজে কি শিক্ষার্থীরা বাধা দিয়েছে? আর যদি করেই থাকে তাহলে পুলিশের উচিত শিক্ষার্থীদের দিকটিও যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা। তাদেরও বোঝা উচিত, এটা একটি যৌক্তিক দাবি।’
এর আগে ২০১৮ সালে যখন কোটা সংস্কারের আন্দোলন করা হয় তখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে আইসিটি আইনে মামলায় হয়। আটকও করা হয় কয়েকজন সংগঠককে। ওই সময় আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হাসান আল মামুন একটি বিদেশি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বলেন, তাঁদের ১০ জন যুগ্ম আহ্বায়ককে গ্রেফতার করা হয়েছে৷ এর বাইরে যারা আছে, তারা সবাই পলাতক৷ তারা বাড়িঘর বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলে থাকতে পারছে না। আমি নিজেও ঢাকা শহর ছেড়েছি। এখন নানাভাবে নানা জায়গায় থাকছি। ওই আন্দোলনের সংগঠক শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন মানবাধিকারকর্মীরা।
এনএইচ