কারামুক্ত হবেন ইমরান খান
Share on:
পার্লামেন্ট নির্বাচনের ক‘দিন আগেও বেশ বেকায়দায় ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার দল। একের পর এক মামলায় সাজা দেওয়া হচ্ছিল সাবেক এই ক্রিকেটারকে, করা হচ্ছিল জরিমানাও।
নির্বাচনী প্রচারণায় বেগ পেতে হয়েছে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। মনে করা হচ্ছিল, হাতে গোনা কয়েকটি আসন পেতে পারেন ইমরান খান সমর্থিতরা। তবে সেই ধারণা পাল্টে যায় ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে। চূড়ান্ত ফলাফলে ‘চোখ কপালে’ ওঠার অবস্থা, অর্থাৎ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ‘ধারণা’ থেকে গেল ‘ধারণা’তেই। প্রশ্ন উঠছে— সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পর্ক ভালো হয়েছে ইমরান খানের, কারামুক্ত হবেন তিনি, প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন ইমরান খান?
আইনজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা বলছেন— আদালত ইমরান খানের সাজা বাতিল করতে পারবেন। কারণ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো ভিত্তি মজবুত নয়। বরং অনেক অনিয়ম রয়েছে।
- নির্বাচনে অংশ নিয়ে কতটা লাভ হলো ইমরান খানের?
নির্বাচনের আগে বেশ বেকায়দায় আর অস্তিত্ব সংকটে থাকলেও দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়েছে পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্ররা। বহু আসনে জয় পেয়ে ফেডারেল এবং প্রাদেশিক পরিষদে যেতে পুরোপুরি তৈরি ইমরান খানের দল।
দেশটির পাঞ্জাব প্রদেশে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পিটিআইয়ের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আর খাইবার পাখতুনখোয়ায় তারা দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয় পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।
পাকিস্তানের প্রাদেশিক এবং জাতীয় পরিষদের কয়েক ডজন প্রার্থী (তেহরিক-ই-ইনসাফ সমর্থিত) নির্বাচন কমিশনে তাদের পরাজয়কে চ্যালেঞ্জ করেছেন।
তেহরিক-ই-ইনসাফের দাবি— তাদের উত্থাপিত অভিযোগগুলোর স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া উচিৎ। তাহলে পরিস্থিতি তেহরিক-ই-ইনসাফের জন্য আরও অনুকূল হবে।
তবে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে পিটিআই নেতাদের। তারমধ্যে, ফেডারেল এবং প্রাদেশিক পরিষদে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কীভাবে প্রমাণ করবেন, কীভাবে সরকার গঠন করবেন, অন্য রাজনৈতিক দল থেকে তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কীভাবে সুরক্ষা দেবেন?
কারাবন্দি তেহরিক-ই-ইনসাফ প্রধান ইমরান খানের সামনে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনে তার সমর্থিত প্রার্থীরা যে জনসমর্থন পেয়েছেন তা থেকে তিনি কীভাবে লাভবান হতে পারেন এবং সেটা আসলে কতখানি।
ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন নেটওয়ার্ক। পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের প্রাথমিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী— তেহরিক-ই-ইনসাফ সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এই নির্বাচনে সারাদেশ থেকে ১৬ লাখ ৮০ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন। এই জনসমর্থন ইমরান খানকে নিয়ে বর্তমান চিন্তা ও নীতি পরিবর্তন করতে ক্ষমতাসীনদের প্রভাবিত করতে পারবে?
- কারামুক্ত হবেন ইমরান খান?
অতি শিগগিরই ইমরান খানের কারামুক্তির সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন অধিকাংশ আইন বিশেষজ্ঞরা। হাফিজ আহসান খোখার তাদের একজন। এই আইন বিশেষজ্ঞ মনে করেন— মুক্তি পেতে হলে ইমরান খানকে আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
আদালত বিভিন্ন মামলায় তাকে সাজা দিয়েছে। এসব সাজা স্থগিত বা বাতিল করতে হলে আদালতে যেতে হবে। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের হয়তো রাজনৈতিক সুবিধা দেবে, তবে আদালতে তেমন কোনো কাজে আসবে না।
হাফিজ আহসান খোখারের মতে, আদালতে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে ইমরান খানকে অনেক জটিলতা মোকাবেলা করতে হবে। কারণ অনেক মামলায় তিনি ‘দোষ স্বীকার’ করেছেন। যেমন- সাইফার মামলা, তোশাখানা বা সম্পদবিষয়ক মামলা।
আইনজীবী হাফিজ আহসান খোখার বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাজা কমানোর ক্ষেত্রে আইনি ছাড় পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তার দল সরকার গঠন করছে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে— ফেডারেল এবং প্রাদেশিক পরিষদে ইমরান খান সমর্থিত প্রার্থী থাকার মানে হচ্ছে, এই দুই জায়গাতেই ইমরান খানের পক্ষে নানাভাবে আওয়াজ তোলা হবে। ইমরান খানকে যেসব মামলা এবং যে প্রক্রিয়ায় সাজা দেওয়া হয়েছে সে বিষয়েও ভিন্ন মত উঠে আসবে।
- ইমরান খানের সাজা বাতিলের উপায় কী?
ইমরান খানের সাজা বাতিল করে কারামুক্তিতে দুটি উপায় আছে বলে মনে করছেন লাহোরভিত্তিক সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ ও একজন আইনজীবী। নামপ্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, প্রথমত. সরকার গঠন করে ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রী হতে হবে। এরপর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে তার সাজা বাতিল বা কমানো যাবে।
এই পদ্ধতিতে তিনি হয়তো বের হয়ে আসতে পারবেন। কিন্তু খালাস পেয়েছেন বলা যাবে না। কারণ এই পদ্ধতিতে তিনি আইনগত বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করার মাধ্যমে খালাস পাচ্ছেন না।
দ্বিতীয়ত. সরকার গঠন করলে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মামলা তুলে নিতে পারেন। এতে তিনি বের হয়ে আসতে পারবেন। এর আগেও বেশ কয়েক বার রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে আমরা এই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখেছি।
আসাদ জামাল একজন আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞ। তিনি মনে করেন— এটা একটা পদ্ধতি হতে পারে। কিন্তু তার মতে, মামলা যদি তুলে নেওয়া নাও হয়, তারপরও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর হাতে আরও বিকল্প থাকবে।
তিনি বলেন, সাজার বিরুদ্ধে তারা আপিল করতে পারবেন। তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা দায়ের করা হয়েছে সেগুলোর ভিত্তি খুব একটা মজবুত নয়। বরং অনেক অনিয়ম রয়েছে। তাই আদালত তাৎক্ষণিকভাবে সাজা স্থগিত কিংবা বাতিল করতে পারেন। তবে এসব বিকল্প উপায় অবলম্বন করা তখনই সম্ভব হবে, যখন পিটিআই সরকার গঠন করবে।
যদিও নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলীম লীগ-পিএমএল-এন ও বিলাওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) একজোট হয়ে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সেটা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না।
- ‘উপায় আছে তবে...’
সাংবাদিক ও বিশ্লেষক সালমান ঘানি মনে করেন— কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বর্তমান পরিস্থিতিতেও জেল থেকে ছাড়া পেতে পারতেন। কিন্তু জেল থেকে দেওয়া তার সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্যের কারণে মনে হচ্ছে না যে, সেটা আর সম্ভব হবে।
সালমান ঘানি বলেন, গত কয়েক ঘণ্টায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে একটি আলাপ শোনা যাচ্ছিল। সেটা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া প্রধান দলগুলো মিলেই সরকার গঠন করা উচিৎ। কিন্তু এখন তারা দাবি করছে, এমনটা হয়তো হবে না। কারণ সামরিক বাহিনীর কাছে কোনো গ্যারান্টি নেই যে, ‘ইমরান খান জেল থেকে বের হয়ে এসে আবারও সব কিছু নষ্ট করে ফেলবেন না।’
সালমান ঘানি মনে করেন— ইমরান খান সম্প্রতি জেল থেকে বলেছেন, তিনি বড় কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জোট করবেন না, সেটির কারণে মনে হচ্ছে তিনি আসলে সমঝোতার রাজনীতি করতে চান না। তাই সাম্প্রতিক ম্যান্ডেটগুলোর কারণে ইমরান খান ব্যক্তিগতভাবে কোনো সুবিধা পাবেন বলে মনে হচ্ছে না।
- প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন ইমরান খান?
আইনজীবী এবং আইন বিশেষজ্ঞ হাফিজ আহসান খোখার মনে করেন, ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব না। তাদের মতে, ইমরান খান যদি কোনোভাবে জামিন পেয়ে জেল থেকে বের হয়ে আসেন বা তার সাজা স্থগিতও করা হয়, তাহলেও তিনি একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি।
এই আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, ইমরান খান মজলিস-ই-শূরার সদস্য নন এবং হতেও পারবেন না। কারণ তিনি দুটি মামলায় দীর্ঘদিনের সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। জবাবদিহিতামূলক একটি আদালত থেকেও তার বিরুদ্ধে সাজার রায় দেওয়া হয়েছে। ফলে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বা কোনো সরকারি পদে আসীন হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন।
হাফিজ আহসান খোখার বলেন, তিনি অন্তত পাঁচ বছর অযোগ্য হিসেবে থাকবেন এবং এর পাশাপাশি তাকে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে লাহোরের একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেছেন, তিনিও হাফিজ আহসান খোখার সাথে একমত পোষণ করেছেন। তার মতে— সংবিধানের ৬৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সাজার মেয়াদ যদি তিন বছরের বেশি হয়, তাহলে ইমরান খানের সাজা শেষ হওয়ার পর থেকে পাঁচ বছর অযোগ্য হওয়ার মেয়াদ শুরু হবে। তার মানে হচ্ছে- যেদিন তার সাজা শেষ হবে, অযোগ্য হওয়ার সময়সীমাও তখন থেকে শুরু হবে।
তবে আইনজীবী আসাদ জামাল অবশ্য মনে করেন, ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। তার মতে, সরকার গঠন করে ইমরান খানের সাজা বাতিল করা গেলে অযোগ্যতার সময় সীমাও বাতিল হয়ে যাবে। তখন তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও হতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে এমন কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না।
পিটিআই সমর্থিতরা নির্বাচনে বেশ কিছু আসনে জয় পাওয়ার পর, মনে হচ্ছে দেশটির সামরিক বাহিনীর সাথে তার সম্পর্ক হয়তো আগের তুলনায় কিছুটা ভালো হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সাংবাদিক ও বিশ্লেষক সালমান ঘানি মনে করেন, ইমরান খান নিজে, তার দল এবং দলীয় কর্মী যারা সমস্যার মধ্যে রয়েছেন তাদের জন্য পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে এই ম্যান্ডেট ব্যবহার করার এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ। কিন্তু ইমরান খান এখনো বিদ্বেষমূলক রাজনীতির চর্চায় বিশ্বাসী বলে মনে হচ্ছে এবং সামরিক বাহিনীও তার সাথে আলোচনার মেজাজে আছে বলে মনে হচ্ছে না।
আইনজীবী আসাদ জামাল বলেন, সম্পর্ক ভালো হওয়াটা খুব কঠিন। তার মতে, ইমরান খানের সাম্প্রতিক বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে তার সমর্থিত প্রার্থীরা বিদ্বেষ এবং বিরোধী রাজনৈতিক চর্চার কারণেই জয়ী হয়েছে।
তারা এখন যে অবস্থায় আছে, তাতে মনে হচ্ছে সমঝোতার রাজনীতি থেকে তারা লাভবান হবে না এবং তাদের এটা দরকারও নেই। তারা মনে করে বিদ্বেষমূলক রাজনীতিতে থাকলেই ভবিষ্যতে তারা তাদের রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করতে পারবে।
আসাদ জামালের মতে— ইমরান খান বোঝেন বিদ্বেষমূলক রাজনীতি থেকে তিনি এই মুহূর্তে কোনো সুবিধা হয়তো পাবেন না, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে অর্থাৎ এক বছর বা ছয় মাস পর তিনি হয়তো সুবিধা পাবেন। সূত্র: বিবিসি
এনএইচ