শীতে কষ্ট পাচ্ছেন হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় থাকা রোগীরা
Share on:
হাড় কাঁপানো শীতে কাঁপছে রাজধানীসহ সারা দেশ। ঘন কুয়াশার কারণে দুপুরেও সূর্যের দেখা মিলছে না।
হিমেল বাতাস যেন শরীরে ‘কামড়’ বসাচ্ছে। রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় অবস্থান করে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা শীতে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। ওয়ার্ডে বা কেবিনে সিট না পাওয়ায় রাতদিন মেঝেতে জবুথবু হয়ে শুয়ে থাকছেন তারা।
সোমবার (২২ জানুয়ারি) রাজধানীর মহাখালী জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতাল এবং জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।
চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা বলছেন, শীতের সঙ্গে মৃদু বাতাসে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে হাড়ে কাঁপুনি ধরে তাদের। বিশেষ করে মেঝেতে ও বারান্দায় থাকা রোগীদের অবস্থা খুবই নাজুক। চিকিৎসকরা বলছেন, রোগীরা রোগের চেয়ে শীতেই কাবু হচ্ছেন বেশি। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রংপুর থেকে স্ত্রীকে নিয়ে ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন গোলাম রাব্বানী। রোগীদের ভিড়ে জায়গা হয়নি হাসপাতালের ভেতরে। তাই বাধ্য হয়ে বিছানা পেতেছেন হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতে। তিনি জানান, প্রচণ্ড শীত, তাই অসুস্থ স্ত্রী শুয়ে আছে। অসুস্থ মানুষটাকে তো আর বসিয়ে রাখা যায় না।
গোলাম রাব্বানী বলেন, হাসপাতালে কোনো সিট পাইনি। তাই স্ত্রীকে বাধ্য হয়ে ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে শুইয়ে রাখছি। একদিকে ঠান্ডা বাতাস, অন্যদিকে ফ্লোরের ঠান্ডা- এ পরিস্থিতিতে এখােনে টেকাই কষ্টকর হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, শীত লাগছে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু যদি দিনের পর দিন ঘুরেও একটা সিট না পাই, তাহলে তো স্ত্রীকে ফ্লোরে রেখে চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে যাবে। ছয় দিন যাবৎ সিটের জন্য ঘুরছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। ডাক্তার বলেছে ক্যান্সার হয়েছে। এখন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মাস খানেক আগেও একবার এসেছি। তখন কয়েক দিন এভাবে কষ্ট করে বারান্দায় থেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়েছি। তখনও সিটের ব্যবস্থা করতে পারিনি। আমরা গরীব মানুষ, কিন্তু চিকিৎসা তো করাতে হবে। ঢাকায় আমাদের কোনো আত্মীয় নেই, তাই হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারলে চিকিৎসা করানো কঠিন।
ডেমরা এলাকা থেকে গলার ক্যান্সার চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে এসেছেন শাহজাদী বেগম নামক এক বয়ষ্ক নারী। হাসপাতালটির চতুর্থ তলায় মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। শীত প্রসঙ্গে শাহজাদী বেগম বলেন, সকাল থেকেই বিছানায় বসে আছি। এত ঠান্ডায় ফ্লোরে শুয়ে থাকা যায় বাবা? দরজা-জানালা সব খোলা থাকে, এগুলো দিয়ে সবসময় বাতাস ঢোকে। শীতে কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। মনে হচ্ছে শীতেই মরে যাব।
হাসপাতালে চিকিৎসার পরিবেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এত রোগী, বাথরুমগুলোর অবস্থা খারাপ। গিয়ে কুলি করে আসারও সুযোগ নেই। ওইদিকে গেলেই বমি চলে আসে। এগুলো একটু দেখা দরকার।
শাহজাদী বেগমের সঙ্গে আসা নাতনি রাইদা ইসলাম বলেন, দাদিকে নিয়ে হাসপাতালে আসলাম। কিন্তু এখানে এসে মনে হচ্ছে, এভাবে থাকলে বরং আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যাবে দাদি। এখন পর্যন্ত কোনো সিট পাইনি। এমন শীতের মধ্যে এমন একটা রোগীকে মেঝেতে কীভাবে শুইয়ে রাখব? আর আমরাই বা কী করব?
তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই রোগীর সাথে কোনো না কোনো লোক থাকবেই। কিন্তু তাদের জন্য হাসপাতালে কোথাও বসার জায়গা নেই৷ একদিকে রোগীও চিকিৎসা নিতে এসে কষ্ট পাচ্ছে, রোগীর স্বজনরাও কষ্ট পাচ্ছে।
নেত্রকোণা সদর উপজেলা থেকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন রহিমা বেগম। তিনি বলেন, গত পরশু রাতে হাসপাতালে এসেছি। এমনিতেই সর্দি-কাশি, এরপর আবার শীতে অবস্থা খুব খারাপ। দিনে কোনো রকমে থাকতে পারলেও রাতে ঠান্ডা সহ্য করা কঠিন হয়ে যায়।
রহিমা বেগম বলেন, বাড়ি থেকে কিছু কাঁথা-কাপড় নিয়ে এসেছি, এগুলো দিয়েই কোনো রকমে থাকছি। কী করা যাবে, কষ্ট হলেও তো চিকিৎসা নিতে হবে।
ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্তব্যরত একজন চিকিৎসক বলেন, গত কয়েক দিনের শীতে রোগীদের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে যতটুকু পারি দেখছি, কিন্তু কিছু তো করার নেই। আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। দেখতেই পারছেন কী পরিমাণ রোগী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে শীতের সময় সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাইটিস, ব্রঙ্কিওলাইটিস ও সাইনোসাইটিসসহ দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের রোগ। এসব রোগ থেকে সুরক্ষায় শীত এড়িয়ে চলতে হয়। প্রয়োজনে নিতে হয় চিকিৎসকের পরামর্শ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সোমবার দিনের অধিকাংশ সময়ই ঢাকার আকাশ অস্থায়ীভাবে কুয়াশাচ্ছন্ন থাকতে পারে। সোমবার (২২ জানুয়ারি) সকালে প্রকাশিত ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য সকাল ৭টা থেকে পরবর্তী ৬ ঘণ্টার জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আকাশ অস্থায়ীভাবে মেঘলা থাকতে পারে। আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। এ সময়ের মধ্যে হালকা থেকে মাঝারী ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে।
আর উত্তর অথবা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ৬-১০ কিলোমিটার বেগে বাতাস প্রবাহিত হতে পারে। তাছাড়া, দিনের তাপমাত্রাও সামান্য হ্রাস পেতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
কনকনে শীতে কাঁপছে সারা দেশের মানুষ। দেশের বিভিন্ন জেলায় ১০ ডিগ্রির চেয়েও নিচে নেমেছে তাপমাত্রা। এমন অবস্থায় শীত থেকে বাঁচতে নানা উপায় অবলম্বন করছেন সবাই। হাড় কাঁপানো এই শীত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না কারাবন্দিরাও। তীব্র এই শীত তাদের এমন একটি স্থানে কাটাতে হচ্ছে, যেখানে অন্যান্য স্থানের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা বেশ অপ্রতুল। তাই এমন পরিস্থিতিতে কারাবন্দিদের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কাশিমপুরে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এখানে বন্দি রয়েছেন নয় হাজার ৫০০ জন। এবারের শীতে সরকারিভাবে তাদের একাধিক কম্বল দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, যেসব বন্দি শীতবস্ত্র সংগ্রহ করতে পারেননি, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কারা কর্তৃপক্ষ বন্দিদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় কয়েক হাজার বন্দির মধ্যে শীত বস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া, তাদের জন্য আরও শীত বস্ত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের (কেরাণীগঞ্জ) সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, কনকনে শীতে বন্দিদের সুরক্ষার জন্য আমরা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আমাদের কারাগারে বর্তমানে সাড়ে নয় হাজার বন্দি রয়েছেন। প্রতিজন বন্দিকে সরকারিভাবে একাধিক কম্বল দেওয়া হয়েছে, যাতে করে তারা এই শীতে কোনো কষ্ট না পান।
তিনি বলেন, কারাগারে অনেক দরিদ্র বন্দি রয়েছেন, যারা শীতবস্ত্র সংগ্রহ করতে পারেননি। তারা যেন এই শীতে কোনো ধরনের কষ্ট না পান, আমরা নিজস্ব উদ্যোগে তাদেরকে শীতবস্ত্র বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার শীত বস্ত্র বন্দিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। আমরা আরও শীত বস্ত্র সংগ্রহ করছি বন্দিদের মাঝে বিতরণের জন্য। এক কথায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিরা শীতে কোনো কষ্ট পোহাচ্ছেন না।
এমএইচ