বেইলি রোডের ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু
Share on:
রাজধানীর বেইলি রোডের ‘কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের’ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঘটনায় অন্তত ৪৬ জন নিহত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্তলাল সেন ৪৩ জনের মৃত্যুর তথ্য জানান। আর পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল ফারুক সাংবাদিকদের জানান, এই অগ্নিকাণ্ডে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে একজন মারা গেছেন। পরে আরও দুই জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
ভবনটিতে একাধিক রেস্টুরেন্ট, তৈরি পোশাক এবং মোবাইল ফোনের দোকান ছিল। সাত তলা ভবনের প্রতিটি তলা আগুনে পুড়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সংবাদ পেয়ে আমি দ্রুত হাসপাতালে চলে এসেছি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে দ্রুত আসতে বলেছেন। এখানে এসে যা দেখলাম তা ভয়াবহ। শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এখন পর্যন্ত ১০ জন মারা গেছেন। অপর দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩৩ জন মারা গেছেন।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘যারা এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন তাদের বেশির ভাগের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। যারা বেঁচে আছেন তাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আহতরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন। বাইরে কেউ আছেন কিনা এখনও তথ্য পাওয়া যায়নি। ঢামেক ১৪ জন এবং বার্নে ৮ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে তারা গুরুতর অবস্থায় আছেন।’
তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সবাইকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানান, ঘটনাস্থল থেকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয় ৪২ জনকে। তাদের মধ্যে চার শিশু ও ২১ নারী ছিলেন। বাকিরা পুরুষ। এ ছাড়া জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে।
আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল ফারুক সাংবাদিকদের আরও জানান, বেইলি রোডের ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৩৩ জন। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন ১০ জন।
ঢামেক পরিচালক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এখন যাদের উদ্ধার করে আনা হচ্ছে তাদের অধিকাংশই গুরুতর আহত। আগুন নেভানোর পর সাফোকেশনের ফলে অনেকের শ্বাসরোধ হচ্ছে।’
যারা আগুনে না পুড়েও বিভিন্নভাবে আহত হয়েছেন তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে আনা হচ্ছে। অধিকাংশই লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. রিজভী আহমেদ।
সারি সারি লাশ দেখে, স্বজনদের আহাজারিতে ভারী পুরো এলাকা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সারি সারি পড়ে আছে বেইলি রোডের ভবনে লাগা আগুনে নিহতদের লাশ। আপনজনদের মরদেহ নিতে মর্গের পাশেই অপেক্ষা করছেন নিহতদের স্বজনরা। তাদের আহাজারিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা যেন ভারী হয়ে উঠেছে।
শুক্রবার (১ মার্চ) ভোর ৫টা ২০ মিনিটে সরেজমিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গ ও জরুরি বিভাগের সামনে দেখা যায়, আগুনে পুড়ে নিহতদের মরদেহ নিতে স্বজনরা অপেক্ষা করছেন। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। কেউ কেউ নিহত স্বজনের স্মৃতি মনে করে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন।
ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পাশেই অস্থায়ী তথ্য ও সেবাকেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে স্বজনরা পূর্ণ ঠিকানাসহ অন্যান্য কাগজপত্র জমা দিয়ে মরদেহ বুঝে নেওয়ার প্রক্রিয়ার শেষ করছেন। তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে কোনো মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
ডিএমপির রমনা বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ সালমান ফারসী বলেন, এখনো মর্গ থেকে কোনো লাশ বের করা হয়নি। নিহতের স্বজনরা এসেছেন, কাগজপত্র যাচাই-বাছাই চলছে।
কেউ নিখোঁজ হলে ঢামেকে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শ
রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল ভবনের আগুনের ঘটনায় কেউ নিখোঁজ থাকলে, তাদের স্বজনদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
ঘটনার পর বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী নিখোঁজদের স্বজনদের উদ্দেশে এ অনুরোধ করেন।
তিনি বলেন, ভবনটি থেকে সবাইকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়েছে। স্বজনেরা সেখানে গেলেই সবার বিষয় তথ্য পাবেন।
৬৮ জনকে উদ্ধার, নারী ১৫
বেইলি রোডে একটি বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ঘটনায় অটকে পড়া ৬৮ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জন নারী। ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেল থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। উদ্ধার ব্যক্তিদের মধ্যে যারা আহত তাদেরকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
আহতরা হলেন—শাকিল (২৪), উজ্জল (২৩), জোবায়ের (২১), ওমর ফারুক (৪৩), শাকিল (২২), জুয়েল (৩০) ও সিজান (২২)।
চিকিৎসকের বরাত দিয়ে ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, ভবনের বিভিন্ন তলায় আটকা পড়েছিলেন তাঁরা। তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে আহত হন। জরুরি বিভাগে তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে এই কমিটি গঠন করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।
কমিটির প্রধান করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। সদস্যসচিব হলেন- ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন। সদস্য করা হয় সংশ্লিষ্ট জোনের ডিএডি, সিনিয়র স্টেশন অফিসার ও ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টরকে।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটে রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ভবনে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে আগুন লাগার সংবাদ আসে ফায়ার সার্ভিসের কাছে। এরপর ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত ১১টা ৫০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ভবনটিতে তল্লাশি চালান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। রাত আড়াইটা নাগাদ তারা ভবনটি ছেড়ে যান। এসময় ঘটনাস্থলে দেখা যায়, আগুন নেভাতে আসা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো একে একে ঘটনাস্থল ত্যাগ করছে। আর ভবনটির সামনে বাড়ানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা। ভবনটির সামনে অবস্থান করছেন পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা। এছাড়া ঘটনাস্থলে একাধিক অ্যাম্বুলেন্স রাখা হয়েছে।
উপস্থিত ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানান, তল্লাশি শেষে সিলগালা করা হয়েছে ভবনটি। এখন ভবনটির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
এছাড়া এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (মিডিয়া) শাজাহান শিকদার।