চালকরা বেপরোয়া, সড়কে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল
Share on:
কোনো ভাবেই সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়কে প্রান ঝরছে।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের চকরিয়ায় পিকআপ ভ্যানের চাপায় ছয় ভাই নিহত হন। এক সঙ্গে ছয় ভাইয়ের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে ওই পরিবারের স্বজনরা শোকে স্তব্দ। যারা এ খবর শুনছেন তারাও শোকাহত হয়েছেন। এরআগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ট্রাকচাপায় এক শিক্ষার্থী নিহত ও অপর আরেক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার প্রতিবাদে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন রাবি শিক্ষার্থীরা। দুর্ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে অন্তত ৩০০-৪০০ শিক্ষার্থী মহাসড়ক অবরোধ করে। এ সময় তারা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সড়কের বিভিন্ন অংশে টায়ার, কাঠ পুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পাঁচটি ট্রাকে আগুন ধরিয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
সড়কে যাত্রী সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন-বেপরোয়া গতি-চালকদের অদক্ষতাসহ ১০ কারণে ঘটেছে এসব দুর্ঘটনা’। সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। পরিবহন খাতের এই নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ রাজনীতির ধারাবাহিক চর্চার কারণে গড়ে উঠেছে। এখানে অনেকগুলো কারণ জড়িয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে। তবে প্রধান ও উৎস কারণ দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির তথাকথিত রাজনীতি। তাই সমস্যাটির সমাধান করতে হলে সরকারকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। দেশের সুষম ও টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সাশ্রয়ী ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা। সেজন্য জাতীয় স্বার্থেই সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সরকারের মনোযোগী হওয়া উচিত।
করোনা মহামারীর মধ্যও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমেনি। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সম্প্রতি তাদের ‘বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন ২০২১’ প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২১ সালে দেশে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ৮০৯ জন। আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৩৯ জন। সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট দুর্ঘটনার ৯১ শতাংশই সড়কে ঘটছে। গণমাধ্যম থেকে সংগ্রহীত তৈরি করা তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্য গত বছর ৮৫ দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও আগের বছরের তুলনায় জাতীয় মহাসড়কে দুর্ঘটনা আড়াই শতাংশ বেড়েছে। মোট দুর্ঘটনার প্রায় ৩২ শতাংশ ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে আঞ্চলিক মহাসড়কে ৩৯ শতাংশ। দুর্ঘটনার ৩০ শতাংশ ঘটেছে ট্রাক, পিকআপ, লরি ও কাভার্ড ভ্যানে।
প্রতিবেদন ২০২১’-এ বলা হয়েছে, ২০২১ সালে সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট ৬ হাজার ২১৩টি দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫১৬ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৯ হাজার ৭৫১ জন। ৪০২টি রেল দুর্ঘটনায় ৩৯৬ জন নিহত এবং নৌপথে ১৮২টি দুর্ঘটনায় ৩১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবেদনে যানবাহনের বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, সড়কে চাঁদাবাজি, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, দেশব্যাপী নিরাপদ ও আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থার পরিবর্তে টুকটুকি-ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশানির্ভর গণপরিবহনব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়াসহ সড়ক দুর্ঘটনা ব্যাপক হারে বাড়ার ১৬টি কারণ তুলে ধরা হয়। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বলেন, সড়ক নিরাপত্তা এখন দেশের জন্য করোনা মহামারির চেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
করোনা মহামারির চেয়ে সড়কে বেশি মানুষের মৃত্যু হলেও, সড়ক নিরাপত্তায় সরকারের কার্যক্রম করোনা নিয়ন্ত্রণের মতো দৃশ্যমান নয়। মেট্রোরেল, সড়ক-সেতু সংস্কারসহ যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হওয়ায় জনদুর্ভোগ, দুর্ঘটনা দুটিই বেড়েছে।
সংগঠনের বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন ২০২১-এর তথ্য অনুসারে, দুর্ঘটনার ২৫ শতাংশের বেশি ঘটছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। প্রায় ১১ শতাংশ বাস; প্রায় ১০ শতাংশ নছিমন, করিমন, মাহিন্দ্রা, ট্রাক্টর ও লেগুনা; প্রায় ৯ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা; প্রায় ৯ শতাংশ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক এবং ৬ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি, স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিকল (এসইউভি) ও মাইক্রোবাস সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে পথচারীরা, ১ হাজার ৪৩১ জন। আগের বছরের তুলনায় পথচারীকে চাপা দেওয়ার ঘটনা বেড়েছে ১ শতাংশের বেশি। ২০২০ সালে ৪ হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল ৬ হাজার ৬৮৬ জন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক হাদিউজ্জামান বলেন, সড়ক টেকসই ও আধুনিকায়নের জন্য সরকার যা বিনিয়োগ করছে, তার ফল পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি নির্দেশনা থাকার পরও পরিবহনমালিক-চালক যখন যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণ করতে থাকেন, তখন বুঝতে হবে এ দেশে দুর্ঘটনা শুধু কারিগরি সমস্যা নয়, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ও জড়িত। নীতিনির্ধারকেরা ভারতে সড়কে দেড় লাখ মৃত্যুর তথ্য টানেন। অথচ ভারতে প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের বিপরীতে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে, আর বাংলাদেশ তা ৪৫। অন্য দেশগুলো যখন গণপরিবহনমুখী উন্নয়নের দিকে এগোচ্ছে, তখন এ দেশে মোটরসাইকেলমুখী উন্নয়ন চলছে। মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, পরিবহনের ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষের সঙ্গে সরকারি রাজনৈতিক দলের যে যোগাযোগ, তার ভিত্তিতে পরিবহন খাতের ব্যক্তিরা জনগণকে মানুষ বলে মনে করছেন না। তাঁরা জনগণের পকেট থেকে টাকা বের করে নিচ্ছেন। এই পেশিশক্তির হাত থেকে সড়ক ও যাত্রীদের রক্ষা করতে হবে। সড়ক উন্নয়ন বাজেট যতই বরাদ্দ হোক না কেন, দুর্ঘটনা রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নৈতিকতা গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্ঘটনা রোধে ১২টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সড়ক পরিবহন খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা, সড়ক নিরাপত্তায় বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করা, নতুন গণপরিবহন নামানো, দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তায় তহবিল গঠন ইত্যাদি। দূরত্বের তুলনায় অনেক বেশি ভাড়া নেওয়া হয় অভিযোগ তুলে অনুষ্ঠানে বলা হয়, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়কগুলোতে দূরত্ব মেপে কত টাকা বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তা জানতে এক সপ্তাহের মধ্যে মাঠে নামবে।