tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
জাতীয় প্রকাশনার সময়: ১৬ জানুয়ারী ২০২৪, ২২:০০ পিএম

অবৈধ ক্লিনিক, ভুয়া ডাক্তার রুখবে কে


85

ঢাকার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঁচ বছরের শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় আবারো আলোচনায় এসেছে দেশের অবৈধ ক্লিনিক এবং হাসপাতাল। ওই হাসপাতালটির কোনো লাইসেন্স না থাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতালটি বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামান্ত লাল সেন দেশের সব অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন।


এদিকে হাইকোর্ট মঙ্গলবার আয়ানের পরিবারকে কেন পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপুরণ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হবে না তা নিয়ে মঙ্গলবার রুল জারি করেছেন। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে লাইসেন্স আছে এবং লাইসেন্সবিহীন সব ধরনের হাসপাতাল ক্লিনিকের তালিকা তিন মাসের মধ্যে জমা দিতে বলেছেন। একই সঙ্গে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে সাত দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলেছেন হাইকোর্ট। গত ৩১ ডিসেম্বর বাড্ডার সাঁতারকুলে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শিশু আয়ানকে তারা বাবা-মায়ের সম্মতি ছাড়াই অতিরিক্ত অ্যানেসথেশিয়া দিয়ে খৎনা করানো হয়। এরপর আর শিশুটির জ্ঞান ফেরেনি। ৭ জানুয়ারি রাতে আয়ান মারা যায়। এরপর ওই হাসপাতালের দুই চিকিৎসক ও পরিচালকসহ আরো কয়েকজনকে আসামি করে বাড্ডা থানায় মামলা করেন আয়ানের বাবা শামীম আহমেদ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিম ওই মামলার পর হাসপাতালটি পরিদর্শন করলে হাসপাতাল র্কর্তৃপক্ষ কোনো লাইসেন্স দেখাতে না পারায় হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. মনিরুল আহসান জানান, তারা লাইসেন্স ছাড়াই হাসপতালটি চালু করেছিলেন।

ওই হাসপাতালের ম্যানেজার ( জনসংযোগ) আরিফুল হক স্বীকার করেন, লাইসেন্স নেই, তবে লাইসেন্সের আবেদন করেছেন। আবেদন করে হাসপাতাল বা ক্লিনিক চালু করা বেআইনি বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক। তিনি বলেন, দেশে বেসরকারি অবৈধ ক্লিনিক বা হাসপাতালের বড় একটি অংশ এভাবেই চলছে।

মঙ্গলবার সকালে শিশু আয়ানের বাবা শামীম আহমেদসহ পরিবারের তিন সদস্য দেখা করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামান্ত লাল সেনের সঙ্গে। তখন তিনি অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতাল বন্ধের নির্দেশ দেন। আয়ানের বাবা বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের বিচারের আশ^াস দিয়েছেন। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরই দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলেছেন। কিন্তু মামলার পর এখনো দায়ী চিকিৎসক ও নার্সদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। আর হাসপাতালটি বাইরে থেকে বন্ধ রাখলেও ভিতরে কী হচ্ছে জানিনা। সেখানে সাংবাদিকদের ঢুকতে দেয়া হচেছনা। সাংবাদিকরা ঢুকতে চাইলে তাদের ওপর হামলাও হয়।

অবৈধ হাসাপাতাল ও ক্লিনিক: সারাদেশে কত অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে তার হিসাব নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। তারা ২০২২ এবং ২০২৩ সালে অভিযান চালিয়ে মোট দুই হাজারের বেশি হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করে। এরমধ্যে ২০২২ সালের মে মাসে চারদিনের বিশেষ অভিযানে এক হাজার ১৪৯টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করে দেয়। এরমধ্যে ঢাকা বিভাগ ও শহরে ২৯৬টি। ঢাকার বাইরে বন্ধ করা ৮৬৩টির মধ্যে চট্টগ্রামে ২৮৬টি, রাজশাহীতে ১৩৫টি, রংপুরে ১৪টি, ময়মনসিংহে ১২১টি, বরিশালে ৬৫টি, সিলেটে ৩৫টি এবং খুলনায় ৩০৩টি।

মঙ্গলবার সাভার ও ময়মনসিংহসহ কয়েক জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেগুলোর অধিকাংশই আবার চালু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. মনিরুল আহসান বলেন,“ যেগুলো বন্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে লাইসেন্সপ্রাপ্তও আছে। তাদের যে ত্রুটি ছিলো তারা তা ঠিক করায় আবার চালু হয়েছে। আর অবৈধগুলো কীভাবে চালু হয় আমরা বলতে পাবরনা। এগুলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দেখার কথা। আর আমরা তো বন্ধ করতে পারিনা। আমরা ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়ে বন্ধ করি আদালতের সহায়তায়। তারা আবার আদালতে যায়। অনেকের লাইসেন্সের আবেদন করা আছে বা ট্রেড লাইসেন্স আছে এসব দেখিয়ে আবার চালু করে।”

দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন ১৫ হাজার ৫০০। গত বছরের প্রথম দিকে এই সংখ্যা ছিলো ১২ হাজার। এক বছরেই বেড়েছে সাড়ে তিন হাজার। কিন্তু অবৈধ কত তার হিসাব নেই। তার হিসাব বুঝতে কয়েকটি নমুনা দেয়া যাক। ঢাকার সাভারে নিবন্ধিত ক্লিনিক ৩০টি। কিন্তু সেখানে বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান আছে কমপক্ষে ২০০। সাভারের বেবসরকারি ক্লিনিক ও হাসপতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওয়াকিলুর রহমান বলেন, এখানে অবৈধদের দাপট বেশি। আমরা অবৈধ ক্লিনিকের তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দেয়ার পরও তেমন ব্যবস্থা নিতে দেখিনা। মাঝেমধ্যে অভিযান চললেও আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে উপরের যোগাযোগ আছে। ওইসব ক্লিনিকে প্রায়ই ভুল চিৎসার খবর পাওয়া যায়। মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া যায়।

ময়মনসিংহে নিবন্ধিত ক্লিনিকের সংখ্যা ১২০টি। কিন্তু সেখানে চালু আছে কমবেশি ৩০০। ক্লিনিক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডা. তারা গুলন্দাজ বলেন, এখানে অনেক মানহীন এবং অবৈধ ক্লিনিক আছে। অন্যদিকে কুমিল্লায় নিবন্ধিত ক্লিনিকের সংখ্যা ৪০৪টি। কিন্তু বাস্তবে আছে এক হাজার ২০০।

বাংলাদেশে বৈধ ক্লিনিক ও হাপপাতালের চেয়ে অবৈধর সংখ্যা দুই গুনের বেশি হবে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এক পরিচালক। তিনি বলেন, ওইসব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমি বিপদে পড়েছি। অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তাদের যোগাযোগ অনেক উপরে। এনিয়ে এখন আর কথা বলতে চাইনা। অবসরে আছি। নতুন করে ঝামেলায় পড়তে চাইনা।

বর্তমান পরিচালক ডা. মো. মনিরুল আহসান বলেন, অবৈধ ক্লিনিক নিয়ে আমরা কোনো জরিপ করিনি। তবে আমরা গত দেড়-দুই বছরে আটশ ’র মতো অবৈধ ক্লিনিক পেয়েছি। তাদের অধিকাংশই আবেদন করে বা ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে ক্লিনিক চালাচ্ছিল। এবার হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছে। তাই আমরা একটা জরিপ করব। আর অবৈধ ক্লিনিকের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করি। তারপরও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশ আমরা পেয়েছি। বড় অভিযান শুরু করব, বলেন এই কর্মকর্তা।

বৈধগুলোর কী অবস্থা : হাসপাতাল বা ক্লিনিকের লাইসেন্স পেতে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। ১০ শয্যার একটি ক্লিনিকের লাইসেন্স পেতে হলে ওই ক্লিনিকে কমপক্ষে তিনজন এমবিবিএস ডাক্তার, ছয়জন নার্স ও দুইজন ক্লিনার থাকতে হবে। প্রত্যেকটি বেডের জন্য কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা থাকতে হবে। অপারেশন থিয়েটার হতে হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সেইসঙ্গে আধুনিক যন্ত্রপাতি যা থাকতে হবে তার একটি তালিকাও দেওয়া আছে। এর সঙ্গে থাকতে হবে ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন নম্বর, বিআইএন নম্বর, পরিবেশ ও নারকোটিকস বিভাগের লাইসেন্স। তবে আউটডোর, জরুরি বিভাগ ও অপারেশন থিয়েটার সব ক্লিনিকের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। হাসপাতালের ধরন অনুযায়ী শর্ত নির্ধারণ করা হয়।

আর বাংলাদেশের জেলা, পৌরসভা ও উপজেলা পর্যায়ে যেসব বৈধ বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল আছে তার অধিকাংশই ১০ বেডের লাইসেন্স দিয়ে চলছে। কিন্তু যেসব শর্তের কথা বলা হয়েছে বাস্তবে তা নেই। চিকিৎসক নেই, টেকনিশিয়ান নেই, কয়েকজন নার্স দিয়ে চালানো হয়। আবার নার্সরাও রেজিষ্টার্ড নয়। তাহলে ওইসব হাসপাতাল লাইসেন্স পায় কীভাবে? এনিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসান বলেন, লাইসেন্স দেয়ার আগে হাসপাতাল ভিজিটে যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিম। এটা আগেই তাদের জানিয়ে যাওয়া হয়। ওই ক্লিনিকের লোকজন তখন এমবিবিএস ডাক্তার, রেজিষ্টার্ড নার্স, এবং যন্ত্রপাতি ভাড়া করে আনে। বেডগুলোর দূরত্ব ঠিক রাখা হয়। টিম চলে গেলে বেড আরো বাড়ানো হয়। আর ডাক্তাররা তো থাকেন না। ফলে মানহীন হাসপাতাল লাইসেন্স পায়। পরে এগুলো যে সেগুলো পরিদর্শন করা হবে সেই লোকবল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নাই। তবে লাইসেন্স নিতে হলে আগেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজনকে ম্যাসেজ করতে হয়। ফলে ওইসব শর্ত কোনো বিষয় নয় বলে জানান একজন ক্লিনিক মালিক।

বাংলাদেশ বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সভাপতি ডা. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, সারাদেশে লাইসেন্স প্রাপ্ত বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সাড়ে ১৫ হাজার হলেও আমাদের সদস্য ১২ হাজার। লাইসেন্স নাই এবং মানহীন কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে আমরা সদস্য করিনা। তার কথা, আমরাও চাই অবৈধ হাসাপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করে দেয়া হোক। মানহীনগুলোও বন্ধ করা হোক। কিন্তু তারপরও আছে কীভাবে তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনি বলতে পারবে।

ভুয়া চিকিৎসক: বাংলাদেশে জেলা উপজেলা তো বটেই খোদ ঢাকা শহরেও অনেক ভুয়া চিকিৎক আছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মাঝেমধ্যে তারা ধরাও পড়েন। কিন্তু তারপরও তাদের দমানো যায়না। এই ভুয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করতে গিয়ে গত বছর ঢাকায় একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক হামলারও শিকার হয়েছেন। তবে সবচেয়ে আতঙ্কের কথা হলো বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএসডিসি) থেকে জালিয়াতি করে চিকিৎসক সনদ নেয়ার ঘটনাও ধরা পড়েছে। এরকম ১২ জন ভুয়া চিকিৎসকের সনদ নেয়ার ঘটনা ধরা পড়েছে ২০২২ সালে। বাংলাদেশে এখন রেজিষ্টার্ড চিকিৎসকের সংখ্যা ৮০ হাজারের মতো।

বিএমডিসির ষ্ট্যান্ডিং রিকগনিশন কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, এখন তো অনেক ভুয়া ডাক্তার । ভুয়া ডাক্তারদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার বিএমডিসির নেই। এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ। তিনি বলেন, তবে নিবন্ধন নেয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতি হলে সেটা দেখা বিএমডিসির কাজ। যেমন কোনো চিকিৎসক মারা গেলে তার নামে ভুয়া নিবন্ধন অন্যজন নিয়েছেন এমন হয়েছে। আবার একই নামে আরেকজন ভুয়া ডাক্তারও নিবন্ধন নিয়েছেন এরকম ঘটনাও ধরা পড়েছে। আরেকটি বড় বিষয় হলো অনেক চিকিৎসক বিএমডিসির নিবন্ধন না নিয়েই চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া উচিত বিএমডিসির। তারা তো নিবন্ধন ছাড়া চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন না। এটা বেআইনি। তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিএমডিসির নিবন্ধন আগে কেউ কেউ নবায়ন করতেননা, অনীহা ছিলো। এখন এটা কঠোর করা হয়েছে। নবায়ন না করা হলে ব্যবস্থা নেয়া হয়। আর অনলাইনেই নবায়ন করা যায়।

এনএইচ