ইউক্রেনে কেন আর অস্ত্র পাঠাবে না পোল্যান্ড?
Share on:
ইউক্রেনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদের মধ্যে অন্যতম দেশ পোল্যান্ড বলেছে, তারা আর প্রতিবেশী দেশটিকে অস্ত্র সরবরাহ করবে না।
কিয়েভের শস্য রফতানি নিয়ে কূটনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত জানালো পোল্যান্ড।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি বলেন, অস্ত্র সরবরাহের পরিবর্তে আরো আধুনিক অস্ত্র দিয়ে পোল্যান্ড নিজেদেরকে সুরক্ষিত করার ওপর জোর দিচ্ছে।
পোল্যান্ড এরইমধ্যে ইউক্রেনকে ৩২০টি সোভিয়েত যুগের ট্যাংক এবং ১৪টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান দিয়েছে। দেশটির কাছে দেয়ার মতো আর খুব বেশি অস্ত্র নেই।
যাইহোক, এই পদক্ষেপ দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে কড়া উত্তেজনা চলার সময়েই আসলো।
পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং স্লোভাকিয়া ইউক্রেনের শস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাড়ানোর পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির জাতিসঙ্ঘের দেয়া ভাষণের কারণে মঙ্গলবার কিয়েভের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পোল্যান্ড।
জেলেনস্কি বলেন, ইউরোপে ইউক্রেনের কিছু বন্ধু যেভাবে সংহতি প্রদর্শন করছে তা উদ্বেগজনক। তারা 'রাজনৈতিক মঞ্চে-শস্য নিয়ে একটি রোমাঞ্চকর নাটক তৈরি করেছে'।
ওয়ারশ তার এই মন্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বলেছে, 'পোল্যান্ডকে নিয়ে অযৌক্তিক মন্তব্য করা হয়েছে যারা কিনা যুদ্ধের প্রথম দিন থেকে ইউক্রেনকে সমর্থন করে আসছে।'
ওয়ারশতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূতকে তলব করার কয়েক ঘণ্টা পর মোরাউইকি বুধবার রাতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল পোলস্যাট নিউজকে এক সাক্ষাৎকার দেন।
সেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমরা আর ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাচ্ছি না। কারণ আমরা এখন পোল্যান্ডকে আরো আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত করছি।'
পোল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা প্যাপ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'রাশিয়ার বর্বরদের' পরাজিত করতে একটি সামরিক কেন্দ্র বজায় রেখে ইউক্রেনকে সহায়তা করে আসছিল পোল্যান্ড এবং তাই সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রী অনড় ছিলেন। কিন্তু তিনি শস্য আমদানির মাধ্যমে পোল্যান্ডের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলতে সম্মত ছিলেন না।
ইউক্রেনে স্থানান্তর করার কারণে পোল্যান্ডের সামরিক বাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডার এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে এবং ওয়ারশ এগুলো পশ্চিমাদের তৈরি আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
ইউক্রেনে অস্ত্র রফতানি পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে যাবে না, কারণ পোলিশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পিজিজে আগামী কয়েক মাসে প্রায় ৬০টি ক্র্যাব আর্টিলারি অস্ত্র ইউক্রেনে পাঠাবে।
সরকারের মুখপাত্র পিওতর মুলার পরে বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেন, শুধুমাত্র ইউক্রেনের সাথে সই করা চুক্তি অনুযায়ী এবং এর আগে সম্মত হওয়া গোলাবারুদ ও অস্ত্র সরবরাহ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর করা মন্তব্যের বিষয়ে পোল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী ইয়াসেক সাসিন বৃহস্পতিবার রেডিও প্লাসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর কথা মতোই সব হবে- ভবিষ্যতেরটা পরে দেখা যাবে।'
পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে নির্বাচনী প্রচারণার উত্তাপ বাড়ার সাথে সাথে তাদের বক্তব্য জোরেশোরে তুলে ধরেছে। আগামী ১৫ অক্টোবর দেশটিতে ভোটের আগে তারা পোলিশ কৃষকদের স্বার্থরক্ষায় এগিয়ে এসেছে যারা ইউক্রেনের শস্য আমদানিকে নিজেদের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছে।
রাশিয়ার পূর্ণমাত্রায় আক্রমণের মুখে কৃষ্ণসাগরে জাহাজ চলাচলের প্রধান লেন বন্ধ থাকার কারণে স্থলপথে বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হয়েছে ইউক্রেন।
এর ফলে বিপুল পরিমাণ শস্য মধ্য ইউরোপে গিয়ে পৌঁছায়।
ফলস্বরূপ, স্থানীয় কৃষকদের রক্ষায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের পাঁচটি দেশে শস্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এগুলো হচ্ছে বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং স্লোভাকিয়া। যেখানকার কৃষকরা মনে করছেন যে, শস্য আমদানির কারণে স্থানীয় বাজারে শস্যের দাম কমে যাচ্ছে।
এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হয়ে গেলেও ইইউ এটির মেয়াদ বাড়ায়নি। কিন্তু হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া এবং পোল্যান্ড এই নিষেধাজ্ঞা বলবত রেখেছে। যদিও ইউরোপীয় কমিশন জোর দিয়ে বলেছে যে, বিস্তৃত বাণিজ্য নীতি গ্রহণের বিষয়টি ইইউ এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর নির্ভর করবে না।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় এসব দেশের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইউক্রেন। যার অভিযোগে বলা হয়েছে, এসব দেশ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করেছে।
ইউক্রেনের অর্থমন্ত্রী ইউলিয়া স্ভিরিডেনকো বলেন, 'ইউক্রেনীয় শস্যের রফতানির ওপর একক কোনো সদস্য দেশ যে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে না তা প্রমাণ করাটা আমাদের জন্য জরুরি।'
বৃহস্পতিবার বিভিন্ন সূত্র বলেছে যে, স্লোভাকিয়ার ওপর থেকে মামলা প্রত্যাহারে রাজি হয়েছে কিয়েভ, কারণ দেশ দু'টি বলেছে , আগামী কয়েক মাসের মধ্যে একটি শস্য লাইসেন্স ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে।
পোল্যান্ড বলেছে যে, নিষেধাজ্ঞা আপাতত চলবে এবং 'ডাব্লিউটিও তে একটি অভিযোগের বিষয়টি তাদেরকে প্রভাবিত করবে না।'
মোরাউইকি বলেছেন, কিয়েভ যদি শস্য বিতর্ককে আরো সামনে নিয়ে আসে তাহলে তারা ইউক্রেনের আরো পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে।
বৃহস্পতিবার পোল্যান্ডের কৃষিমন্ত্রী রবার্ট তেলুস ইউক্রেনের কৃষিমন্ত্রী মিকোলা সলস্কির সাথে কথা বলেছেন এবং কিয়েভ বলেছে, দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা করে একটি সমাধান খুঁজে বের করার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন তারা।
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই তিনটি দেশ তাদের ওপর দিয়ে শস্য পরিবহন করে অন্য বাজারে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অব্যাহত রেখেছে।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাথেরিনা কোলোন্না বুধবার বলেন, ইইউ-এর একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে ইউক্রেনের শস্য আমদানির কারণে ইউরোপের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এবং এই উত্তেজনাকে তিনি 'দুঃখজনক' বলে উল্লেখ করেছেন।
পোল্যান্ড ইউক্রেনকে নানা ধরনের সহায়তা করেছে। রাশিয়ার বিপক্ষে নিজেকে রক্ষা করে এটি জার্মানিকে আহ্বান জানিয়েছে যে, তারা যাতে লেপার্ড-২ ট্যাংক পাঠায়। দেশটিকে যুদ্ধবিমান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৫ লাখের মতো ইউক্রেনীয় শরণার্থীকে স্বাগত জানিয়েছে তারা।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের শস্য চুক্তি কী?
সূর্যমুখী তেল, বার্লি, ভুট্টা আর গমের মতো শস্যের সবচেয়ে বড় রফতানিকারকদের মধ্যে ইউক্রেন অন্যতম।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করে তখন দেশটির নৌবাহিনী কৃষ্ণ সাগরীয় বন্দর বন্ধ করে দেয়। ফলে রফতানির জন্য রাখা ২০ মিলিয়ন টন শস্য আটকে পড়ে।
এর ফলে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলো যারা ইউক্রেন থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্য আমদানি করতো সেসব দেশে খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কা দেখা দেয়।
২০২২ সালের জুলাইয়ে তুরস্ক ও জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। যার আওতায় কার্গো জাহাজগুলোকে যাতায়াতের জন্য কৃষ্ণ সাগরে একটি করিডর দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
৩১০ নটিক্যাল মাইল দীর্ঘ এবং তিন নটিক্যাল মাইল বিস্তৃত এই করিডরটি ইউক্রেনের ওডেসা, চরনোমর্স্ক এবং ইউঝনি/পিভডেনাই বন্দরে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হতো।
এর আওতায় রাশিয়ার নৌবাহিনীকে কৃষ্ণ সাগরে ঢোকার আগে বসফরাস প্রণালীতে জাহাজগুলোতে অস্ত্রের খোঁজে তল্লাশি চালানোর অনুমোদন দেয়া হয়।
এই চুক্তির আওতায় প্রায় ৩৩ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য ইউক্রেন থেকে রফতানি করা হয়। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা এফএও এর তথ্য অনুযায়ী, এর ফলে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম প্রায় ২০ শতাংশ কমে যায়।
জাতিসঙ্ঘের খাদ্য মূল্য সূচক অনুযায়ী, রাশিয়া যেহেতু এই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে তাই বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম আবার বাড়বে।
সূত্র : বিবিসি