যেভাবে বদলে যায় দৃশ্যপট
Share on:
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই দেশের পুরো দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
রাজধানী ঢাকার অলিগলির বাসা বাড়ি থেকে শুরু করে ছাত্র-জনতা ও সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে এসে বিজয় উল্লাস করেন। সাধারণ মানুষ নিজেদের মতো করে সেই আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন। তবে এই বিজয় উল্লাস করতে গিয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটেছে। উৎসুক জনতা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, বাসভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ‘গণভবন’ লুটপাট করে পরে অগ্নিসংযোগ করেছে। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। গতকাল বিকাল পৌনে ৪টার দিকে সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা নানা স্লোগান দিতে থাকেন।
এ ছাড়া, ধানমণ্ডি ৩/এ-তে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়েও আগুন দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়ে আগুন দেন আন্দোলনকারীরা। কার্যালয়ে আগুন দেয়া হলে তখন পাশের গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিজয় উল্লাস চলার সময়ে বিজয় সরণিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছে। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে একদল মানুষ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে হাতুড়ি দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করে। পরে ভাস্কর্যটিতে জুতার মালা পরিয়ে দেন আন্দোলনকারীরা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খানের ধানমণ্ডির ভাষায় হামলা চালিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। গতকাল সাড়ে ৩টার দিকে বিক্ষুব্ধ কয়েক হাজার মানুষ বাড়িটির প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর তারা ভাঙচুর করে। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে ধোঁয়া দেখা যায়। তবে ভেতরে কেউ ছিল কিনা তা নিশ্চিত করা যায়নি। এ সময় আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করতে থাকেন। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে একদল লোক রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে অবস্থিত ওই বাসভবনে ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণ পর ভবনের ভেতর থেকে ভাঙচুরের শব্দ শোনা যায়। এ ছাড়া গণভবনের মতো এখান থেকেও অনেক মালামাল নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে তখন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ওই ভবনে অবস্থান করছিলেন কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এটিএন নিউজে ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বিকাল থেকে ভাঙচুর শুরু হয়। এতে ভবনের অবকাঠামো ও টেলিভিশন চ্যানেলটির বিভিন্ন সম্পদ নষ্ট হয়। লুটপাট করে নিয়ে যান আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনকারীরা রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। এ সময় থানার পাশের আরেকটি ভবনের সামনে রাখা সব গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। সেখানে অবস্থানরত সেনা সদস্যরা তাদের থামানোর চেষ্টা করেছেন। দুপুর ২টার পর থেকে এই ঘটনা ঘটে। উত্তেজিত জনতা বাড্ডা থানায় হামলা করেছে। এ সময় জনরোষে পড়ে একের পর এক গুলি ছুড়ে পুলিশ। হামলা ও গুলির ঘটনায় বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন। হতাহত হয়েছেন এমন অভিযোগও করেছেন আন্দোলনকারীরা। তবে হতাহতের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাজধানীর ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকায় অবস্থিত বাড্ডা থানার চতুর্দিক থেকেই স্থানীয় এলাকাবাসী ও আন্দোলনকারীরা ঘিরে রাখেন। এমন পরিস্থিতিতে থানায় আটকেপড়া পুলিশ সদস্যরা কোনোদিকেই বের হতে পারছিলেন না। পরে ভেতর থেকে ওসির নেতৃত্বে গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পুলিশ। একইসঙ্গে আন্দোলনকারীরাও বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিয়ে ইটপাটকেল ছুড়েছেন। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর আদাবর থানায় হামলা চালায় স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় শুরুতে সাধারণ মানুষকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালায় পুলিশ। তবে জনতার রোষানলের কাছে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি পুলিশ। পরে থানা ছেড়ে চলে যান পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ থানা ত্যাগ করার পর থানায় ঢুকে পরে সাধারণ মানুষ। এ সময় থানায় ব্যাপক ভাঙচুর চালায় তারা। একইসঙ্গে থানার লকার, চেয়ার-টেবিলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বের করে নিয়ে আসেন। থানার পাশাপাশি এর সামনে থাকা পরিত্যক্ত মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারেও আগুন দেয়া হয়। এদিন বিকাল ৩টার পর মিরপুরের পল্লবী থানা ঘেরাও করে রাখে কয়েক হাজার মানুষ। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতা থানার ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। ভাঙা হয় পুলিশের কয়েকটি গাড়ি ও মোটরসাইকেলও। মোহাম্মদপুর থানায় হামলা হয় বিকাল ৫টার পর। এরপর আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৬টার পরও আগুন জ্বলতে দেখা যায়। খিলগাঁও থানায় সন্ধ্যার পরও আগুন জ্বলতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালের বাসভবনে হামলা হয়েছে। এ সময় আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা ভিসির বাসায় থাকা সকল নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে প্রধান ফটক ভেঙে বাসায় ঢুকে পড়েন। এর কিছুক্ষণ পর বাসা থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। এ ছাড়াও বাড়ির ভেতরে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। রাজধানীর মিন্টো রোডে মন্ত্রিপাড়ায় প্রতিমন্ত্রীদের বাসায়ও হামলা চালিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। এ ছাড়া রমনায় ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারের বাসভবনেও ভাঙচুর চালানো হয়। সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে এসব ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ সুপারের বাসভবন ও প্রতিমন্ত্রীদের বাসা থেকে বিভিন্ন আসবাবপত্র নিয়ে যেতে দেখা যায় বিক্ষুব্ধ জনতা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের সহযোগিতার অভিযোগ তুলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। এর মধ্যে একাত্তর টেলিভিশন, ডিবিসি, সময় টিভিসহ কয়েকটি গণমাধ্যমের কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সোমবার বিকালে রাজধানীর বারিধারার ডিপ্লোমেটিক জোনের একাত্তর টিভির কার্যালয়ে হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। এ ছাড়া বাংলামোটরে সময় টেলিভিশন, কাওরান বাজারে এটিএন বাংলা, মহাখালীতে ডিবিসি এবং হাতিরঝিলে মাইটিভি কার্যালয়ে হামলা ও ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
রাজধানী ঢাকার গুলিস্তানে পুলিশ সদর দপ্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় দুটি ভবনে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটে। সোমবার রাত পৌনে ৮টার দিকে এসব হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ সদর দপ্তরের ভেতরে থাকা এক কর্মকর্তা জানান, পুলিশ সদর দপ্তরে আগুন দেয়া হয়েছে। দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা জীবন বাঁচাতে দেয়াল টপকে পালাচ্ছেন। এ সময় তিনি সেনাবাহিনীর সহযোগিতা কামনা করেছেন। তবে পুলিশ সদর দপ্তরে তখন আইজিপি আব্দুল্লাহ আল-মামুন ছিলেন না।
এফএইচ