আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক দায়বদ্ধতা
Share on:
আধুনিক দুনিয়াতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হলেও পৃথিবীর সবমানুষ আজও শিক্ষার আলো গ্রহণ করতে পারেনি। এমনকি নিজের পরিচয়ও লিখতে পারেনা লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ এই পৃথিবীর।
তাদের সাক্ষরতা দানের উদ্দ্যেশে ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব সাক্ষরতা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। ১৯৬৫ সালের ৮-১৯ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কোর উদ্যোগে ইরানের তেহরানে বিশ্ব সাক্ষরতা সম্মেলন হয়। ঐ সম্মেলনে প্রতিবছর ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের প্রস্তাব করা হয়। পরে ১৯৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। আর ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো প্রথম দিবসটি উদযাপন করলেও ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে “Promoting literacy for a world in transition: Building the foundation for sustainable and peaceful societies” বাংলাদেশে এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ঘোষণা করা হয়েছে “পরিবর্তনশীল শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে সাক্ষরতার প্রসার”। পৃথিবীর সব মানুষকে নিজেদের অন্যতম মৌলিক অধিকার শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে ও আধুনিক বিশ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতেই মূলত এই দিনটির প্রচলন ঘটানো হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সাক্ষরতা হার যাদের বেশি বৈশ্বয়িক উন্নয়নে ও বিশ্বের নেতৃত্বে তারাই এগিয়ে। সহজ করে বললে বলা যায় সাক্ষরতা আর উন্নয়ন দুটোই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে এই ডিজিটাল দুনিয়াতে। সাক্ষরতাই টেকসই সমাজ গঠনের মূল চালিকাশক্তি ও নেয়ামক শক্তি। টেকসই সমাজ গঠনের জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন তা সাক্ষরতার মাধ্যমেই অর্জিত হয় এবং এটি প্রাথমিক একটি ধাপমাত্র। সাক্ষরতা বলতে সাধারণত অক্ষর জ্ঞানসম্পন্নতাকে বোঝানো হলেও বর্তমানে এর সংজ্ঞা আরও ব্যাপক ভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এখন এর সঙ্গে জীবন ধারণ, যোগাযোগের দক্ষতা ও ক্ষমতায়নের দক্ষতা ও সামাজিক উন্নয়নের ধারনা সংযোজিত হয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই দিবসটি যথাযথভাবে পালনের ও করনীয় গুলো বাস্তবায়নের গুরত্ব অনেক বেশি ও সমায়ের দাবি রয়েছে।
আজকের বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ইউনেস্কো প্রদত্ত সাক্ষরতার সংজ্ঞা ব্যবহার কর্ েসাক্ষরতার ক্ষেত্রে। যদিও এটি একটি ন্যূনতম সংজ্ঞা এবং অনেক উন্নতদেশ এরচেয়ে কঠিন সংজ্ঞা নিজ দেশের সাক্ষরতাকে বিবেচনা করে যা যুক্তিযুক্ত। প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতাতে সাক্ষরতার ধারণা থাকলেও আধুনিক সময়ে তথা ১৯৬৭ সালে ইনেস্কো প্রথম সাক্ষরতার সংজ্ঞা প্রদান করেছে। একসময় কেউ নাম লিখতে পারলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো কিন্তু বর্তমানে সাক্ষর হিসাবে তাকে বলা হয় যে তিন শর্ত পালনে স্বক্ষম প্রথমত, যে ব্যাক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে, দ্বীতিয়ত, সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে এবং শেষটি, দৈনন্দিন জীবনে সাধারন হিসাব নিকাশ করতে পারবে। এই প্রত্যেকটি কাজই হবে ব্যাক্তির প্রাত্যাহিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত। সারা বিশ্বে বর্তমানে এই সংজ্ঞাকেই ভিত্তি করে সাক্ষরতার হিসাব করা হয়। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো এই সংজ্ঞাটি নির্ধারন করে তবে বর্তমানে এটিও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এখন বলা হচ্ছে সাক্ষরতা হলো সরাসরি ব্যাক্তির জীবনমাত্র পরিবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে হবে তথা তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ হওয়া জরুরী।
উন্নত বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন শত সম্ভাবনা থাকার পরও আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ এখনো নিরক্ষরতার বেড়াজালে বন্দি ও তথ্যপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের বর্তমানে সাত ও এর চেয়ে বেশি বয়সী শিক্ষিতের হারর ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ (পুরুষ ৭৬ দশমিক ৬৫ ও মহিলা ৭২ দশমিক ৮২)। মোট জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ এখনও নিরক্ষতার গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে যা আধুনিক বিশ্বে গ্রহণযোগ্য নয় । যাদের অধিকাংশই অধিকার বঞ্চিত এবং দারিদ্রতার দুষ্ট চক্রে বন্দি জীবন-যাপন করছে ও আধুনিক সভ্যতার নির্মম বাস্তবতার স্বাক্ষী। এই দারিদ্রতার মূল কারণই হচ্ছে শিক্ষা এবং তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষতার অভাব। শিক্ষার সঙ্গে সাক্ষরতার আর সাক্ষরতার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বঞ্চিত এবং নিরক্ষর শিশু-কিশোর এবং যুবকদেরকে শিক্ষার মাধ্যমে দেশের জনসম্পদে পরিণত করা দরকার সময়ের দাবী। তাই নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে যার যার অবস্থান থেকে সকলকে এগিয়ে আসা জরুরী। নিরক্ষরতা, ক্ষুধা দারিদ্যতা ও দুর্নীতি এক একটি হানাদার শত্রুর মত। এই শত্রুকে হত্যা করতে যে অস্ত্র দরকার তা হচ্ছে নৈকিত শিক্ষা ও সাক্ষরতা, এজন্য চাই সবার জন্যা শিক্ষা। চাই নিরক্ষর মুক্ত, নৈতিক ও মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও আতœনির্ভরশীল আধুনিক স্মার্ট বাংলাদেশ। আসুন আমরা সমাজ এবং দেশের টেকসই উন্নয়নে কাঁধে কাঁধ মিলাই এবং আলোকিত সমাজ গড়ি ও আগামীর নৈতিকতা সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশর স্বপ্ন বুনি।
আমাদের এই সোনার বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক মূলত জনসম্পাদ যা আমাদের উন্নয়নের মূল শক্তি। সম্ভাবনার এই জনসম্পাদকে শিক্ষিত, নৈতিকতা সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারলেই সফলতা আসবে আমাদের। নিরক্ষরতার হাত থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতে ও সকলের প্রতি এই আহ্বান পৌছে দিয়ে দিবসকে যথাযথভাবে পালনের জন্য বেশকিছু কর্মসূচী গ্রহন করা জরুরী যা আমাদের জন্য সামাজিত দায়বদ্ধতাও বটে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা বা বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে তাদের পড়া-লেখা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া, বিশেষ করে যারা এখন সমাজের মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত হয়নি। আমাদের সমাজের প্রত্যেক সচেতন নাগরিককে নিজ উদ্ব্যোগে কমপক্ষে পাঁচজন নিরক্ষর ব্যক্তিকে অক্ষরজ্ঞান দান নিশ্চিত করা ও তাদের তত্বাবধায়ন জরুরী। সুবিধা বঞ্চিত পথশিশুদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা সামগ্রী প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার প্রতি অনুপ্রাণিত করা এবং ঐসব পরিবারকে আর্থিকভাবে সহোযগিতা করা। গ্রামের শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিবাকদের নিয়ে শিক্ষা সচেতনতামূলক বিভিন্ন সভা-সেমিনার করা ও তাদেরকে নৈতিক শিকক্ষার প্রয়োজনিয়তা বুঝানো। শিক্ষার গুরত্ব এবং প্রয়োজনীতা তুলে ধরে লিফলেট বিতরণ অথবা পোস্টারিং করা ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা সমাজের প্রতিটি স্তরে। বিশেষ করে গ্রামের মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা এবং প্রয়োজনীয় গাইড লাইন প্রদান করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে শিক্ষা সচেতনতামূলক লেখা-লেখি করা ও প্রান্তিক জনগষ্ঠিকে প্রযুক্তির মাধ্যমে সাক্ষরতা প্রদান নিশ্চিত করা। বর্তমান বেকার এবং নিরক্ষর যুবকদের নিয়ে কারিগরি শিক্ষা এবং কর্মশালার আয়োজন করা ও কর্মমুখি শিক্ষার জন্য উৎসাহ দেওয়া। আমাদের দেশের বয়স্ক শিক্ষার হার বাড়াতে এলাকাতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা বিশেষ করে, মসজিদের ইমাম ও অন্য ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের সরকারিভাবে মাসিক সম্মানির ব্যবন্থা করা। সামগ্রিকভাবে শিক্ষানীতির আলোকে সাক্ষরতা দানের উদ্দ্যেশে যথাযথ কর্মসূচী প্রনয়ন করে নারী, কন্যাশিশু, পথশিশু, চর-হাওর, দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন এলাকা, প্রতিবন্ধি, আদিবাসী জনগষ্টি, অনাথ ও ভবঘুরে, এবং এ সমাজের তরুণদের আধুনিক ও মান সম্মত এবং নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষার ব্যাবস্থা করতে হবে। আমরা যদি বাংলাদেশকে একটি সুন্দর সমৃদ্ধ ও কল্যাণকর রাষ্ট হিসেবে তৈরি করতে চায়, তাহলে অবশ্যই সাক্ষরতা দিবসকে সামনে রেখে নিরক্ষরদেরকে স্বাক্ষর জ্ঞানে গড়ে তুলার বিকল্পনেই্। এযুগেও টিপ দেওয়ার প্রথা রয়েছে? অবশ্যই সরকারকে মাষ্টার প্লাননিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে এ সমাজকে। সাথে সাথে তথ্য প্রযুক্তির জ্ঞানে দক্ষতা বৃদ্ধি হলেই স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে। ভৌগলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ্য এই দেশ আগামীর বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে বসবে সেই প্রত্যাশা করতেই পারি।
লেখক: ড. একরাম উদ্দীন সুমন
এডজানক্ট ফ্যাকাল্টি,
নর্দান ইউনির্ভানিটি বালাদেশ