আওয়ামী লীগ নেতাদের পালিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন
Share on:
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নাটকীয় পরিবর্তনের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ নেতাদের নিখোঁজ হওয়া ও দেশ ত্যাগের খবর সম্প্রতি জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, ৬২৬ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও অন্যান্য নেতাদের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবরও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। একই সঙ্গে, বিভিন্ন স্থান থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে যুক্ত প্রায় ১,৫০০ ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন— এসব পালানোর পেছনে ‘সমঝোতা’ সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করছে।
প্রশ্ন উঠেছে, দলটির অন্যান্য প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অনুগত পুলিশ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা কোথায় আছেন?
গত ১৮ আগস্ট সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয় যে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ‘জীবন সংশয়ের আশঙ্কা থাকায়’ ৬২৬ জনকে দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তবে এসব ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি, ফলে বোঝা যাচ্ছে না তারা কি দেশ ত্যাগ করেছেন, নাকি দেশের ভেতরেই আছেন।
সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কলকাতার একটি পার্কে বসে আছেন। শামীম ওসমানকে দিল্লিতে দেখা গেছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন কিংবা অন্য দেশে চলে গেছেন বলে খবর এসেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের তীব্র সমালোচনার লক্ষ্য ছিলেন তৎকালীন সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এই দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছিলেন ছাত্ররা।
আওয়ামী লীগ সরকারে যারা প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাদের মধ্যে সালমান এফ রহমান এবং আনিসুল হক গ্রেফতার হয়েছেন। তবে অনেকেই এখনও গ্রেফতার হয়নি। গ্রেফতার হওয়া সাবেক মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন শাজাহান খান, টিপু মুন্সী, আব্দুল মান্নান, সাবের হোসেন চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নূর, দিপু মনি, জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাধন চন্দ্র মজুমদার এবং সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন— আওয়ামী লীগের অনেক নেতা দেশ ছেড়ে গেছেন এবং এটি সম্ভবত ‘সমঝোতার মাধ্যমে’ ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘সমঝোতার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে সেইফ এক্সিট দেওয়া হয়েছে, বিষয়টি অন্যান্য নেতাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের নামের তালিকা প্রকাশ করা উচিত। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্ট সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে কারা ছিলেন, তা আমাদের জানা নেই। কেউ সেখানে গিয়ে স্বেচ্ছায় চলে যেতে পারেন না, এজন্য একটি প্রক্রিয়া রয়েছে।’
অভিযান চলছে। ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। গ্রেফতার অভিযানে সবচেয়ে বেশি আটক করেছে র্যাব। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত প্রায় ১৫০০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি জানান, আটক ব্যক্তিরা বিভিন্ন মামলার আসামি এবং অনেকেই ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছে।
এছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে জড়িত ও সাবেক মন্ত্রীদের মধ্যে ৩৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিজিবি জানায়, ভারতে পালিয়ে যাবার সময় বিভিন্ন সীমান্ত থেকে ২০ জনের বেশি ব্যক্তিকে আটক করেছে, যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
৩ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী জানিয়েছেন, এমপি, মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এই তালিকায় কয়েকশ নাম রয়েছে এবং এটি শেষ নয়, আরও ব্যক্তিরা রয়েছেন।
বেনাপোল, ভোমরা, দর্শনা, আখাউড়া এবং সিলেটের দোনা সীমান্তে বাড়তি নজরদারি চলছে। বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। যারা ভারতে পালিয়ে গেছেন, তাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হলে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
পালিয়ে ভারত যাওয়ার পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্নার মৃতদেহ মেঘালয়ে পাওয়ার পর পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে যে তাকে খুন করা হয়েছিল। তার সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অর্থ থাকার খবর পাওয়া যায়, যদিও পরবর্তীতে ভারতীয় পুলিশ এটি সঠিক নয় বলে জানায়।
একই সীমান্ত দিয়ে আওয়ামী লীগ-পন্থী সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ভারতে পালানোর সময় বিজিবির হাতে ধরা পড়েন এবং তার কাছেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ছিল। এছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার নামে দলটির ফেসবুক পেইজে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে, তবে তারা কোথা থেকে এসব দিচ্ছেন, তা জানা যায়নি।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কীভাবে ভারতে পালিয়ে গেলেন, এ বিষয়ে বিজিবি মহাপরিচালক জানান, ‘এটা আমারও প্রশ্ন। তিনি কোন দিক দিয়ে গেছেন, তা জানি না। যদি কোনো তথ্য পেতাম, অবশ্যই তাকে আটক করতাম।’
র্যাবের পক্ষ থেকেও আসাদুজ্জামান খানের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। বিজিবি মহাপরিচালক জানিয়েছেন, তাদের ৭২২টি বিওপি রয়েছে এবং প্রতিটি বিওপির মধ্যে গড়ে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত টহল দেওয়া হয়। এই দূরত্বের মধ্যে স্থানীয় কোনো দালাল অর্থের বিনিময়ে কাউকে সীমান্ত পার করিয়ে দিতে পারে।
আওয়ামী লীগের অনেক নেতা দেশ ছেড়ে পালানোর ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফলতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। গত ২ অক্টোবর র্যাবের মুখপাত্র জানান, ‘এখানে উদাসীনতা বা গাফিলতি বলতে চাই না। আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সবটুকু চেষ্টা করছি।’
সরকারও এই বিষয়টি স্বীকার করেছে। গত ৫ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, যারা পালিয়ে গেছে, তারা ৫ থেকে ৭ আগস্টের মধ্যে পালিয়ে গেছেন। ‘এই তিন দিনে সবচেয়ে বেশি পালিয়েছে। এখন পালানোটা তাদের জন্য দুরূহ হয়ে গেছে,” বলেন তিনি। তিনি সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করেছেন এবং বলছেন, “আপনারা ইনভেস্টিগেশন জার্নালিজম করেন, আমাদের দুই-একটা ইনফরমেশন দেন।”
গত ১৮ আগস্ট আইএসপিআর জানায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জীবন সংশয়ের আশঙ্কায় ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিচারক এবং পুলিশের সদস্যরা ছিলেন। পরিস্থিতির উন্নতি হলে ৬১৫ জন স্বেচ্ছায় সেনানিবাস ত্যাগ করেন। আশ্রয় পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তি, ৫ জন বিচারক, ১৯ জন বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা, ২৮ জন পুলিশ অফিসার এবং ৪৮৭ জন পুলিশের সদস্য রয়েছেন। সূত্র: বিবিসি
এনএইচ