আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি
Share on:
বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহারে আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ইস্যু অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানানো হয়েছে।
শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে বৃহত্তর ময়মনসিংহের আদিবাসী সংগঠনসমূহের ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ ইন্ডিজিয়াস ল'ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসী অধিকারসমূহ অন্তর্ভুক্তি ও ২০২২ সালের জনশুমারিতে আদিবাসীদের সঠিক সংখ্যাগত তথ্য যুক্তিকরণের দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়।
সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ইউসিজিএমের সভাপতি মি অজয় এ মৃ, মহাসচিব অরন্য ই. চিরান, বাংলাদেশ আদিবাসী ল ইয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক দীনেশ দারু প্রমুখ।
বক্তব্যে ইউজিসিএমের সভাপতি মি অজয় এ মৃ বলেন, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫০টি বা তার অধিক সম্প্রদায়ের কয়েক লাখ আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে, যাদের শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ সমতল এলাকার বাসিন্দা।
বাকি ২৫ ভাগ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ পার্বত্যাঞ্চল তথা খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও রাঙামাটি এই তিনটি পার্বত্য জেলার অধিবাসী।
সমতল এলাকার আদিবাসীরা দেশের মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের কতিপয় জেলা বাদে প্রায় সবকয়টি জেলাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে আসছে।
তবে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা, উত্তর বঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চল, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার প্রভৃতি জেলাতে বেশি সংখ্যক আদিবাসীর বাস দেখা যায়। এ দেশে আমরা যারা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করি,
আমাদের নিজস্ব ভাষা আছে, পোশাক আছে, সংস্কৃতি আছে, ঐতিহ্য আছে, নিজস্ব বাদ্য যন্ত্র আছে, নিজস্ব খাবার-দাবার আছে যার ওপর আমরা নির্ভরশীল।
তিনি বলেন, গত বিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ শাসকগণ এদেশের বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের আদিবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল, যা প্রায়োগিক কিছু জটিলতার কারণে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
ফলে সমতল এলাকার আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষা বিরাট এক হুমকির মুখে পড়ে যায়। গত শতাব্দীর চল্লিশ দশকের পরবর্তী সময়ে এই হুমকি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ষাটের দশকে এসে সেটি চূড়ান্ত রূপ পায়।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কালে আদিবাসীদের ওপর যে অত্যাচার, নিপীড়ন চালানো হয়েছে তা বিশ্বের অন্যান্য আদিবাসীদের ওপর চালানো নিপীড়ন নির্যাতনের চাইতে বহুগুণে বেশি।
বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নানা উপায়ে সেইসব নির্যাতন- নিপীড়ন প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে চলছে যা আদিবাসীদের নিঃস্ব করেছে কিংবা দেশান্তর হতে বাধ্য করেছে।
তাই, এদেশের বিশেষভাবে সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের সমস্যা ও সেগুলো নিরসনের উপায়সমূহ বের করতে গেলে এদেশের মানবসৃষ্ট বিভিন্ন প্রেক্ষাপটগুলোকেও অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে, যা আদিবাসীদের বর্তমান পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
সভাপতি বলেন, বর্তমান সরকার এ দেশের আদিবাসীদের জন্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আইন ২০১০ প্রণয়ন করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩ (ক) ধারায় সংযোজন করেছে যা আদিবাসীদের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা ছিল।
উক্ত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে তাতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি।যার মাধ্যমে তাদের অধিকার ও অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে।
তাই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার নিমিত্তে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ইস্যুসমূহ অন্তর্ভুক্তির দাবি জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে যেসব দাবি জানানো হয় সেগুলো হলো—
১. বাংলাদেশ সংবিধানে আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে।
২. আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য ‘পৃথক মন্ত্রণালয়’ গঠনসহ একজন আদিবাসীকে পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করতে হবে।
৩. আদিবাসীদের জন্য মহান জাতীয় সংসদে ৫% সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ দিতে হবে।
৪. সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি ‘পৃথক ভূমি কমিশন’ গঠন করতে হবে।
৫. মহান সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে সমতল আদিবাসী নারীদের মনোনয়ন প্রদান করতে হবে।
৬. আইএলও কনভেশন নং ১০৭ এর আলোকে আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন পূর্বক তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
৭. শিক্ষা ও সরকারি চাকরির সকল স্তরে আদিবাসীদের জন্য ৫% কোটা বরাদ্দ বহাল রাখতে হবে।
৮. আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে) ও প্রশাসনের বিভিন্ন কমিটিতে আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
৯. আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা বন মামলাসহ ও অন্যান্য হয়রানিমূলক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে এবং নতুন করে মিথ্যা বন মামলা দায়ের করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
১০. আদিবাসী এলাকায় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প তৈরির পূর্বে আদিবাসীদের সঙ্গে সুস্পষ্ট আলোচনা করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
১১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা ও জীবিকা নির্বাহ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের মতবিরোধ রয়েছে, যা প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে আসছে।
এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর ময়মনসিংহ বিভাগে বসবাসরত ৮টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী তথা; গারো, হাজং, কোচ, বর্মণ, বানাই, ডালু, হদি, ক্ষত্রিয় ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর ওপর গত ২০২১ সালে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কারিতাস বাংলাদেশ ময়মনসিংহ অঞ্চল কর্তৃক একটি আদিবাসী জনশুমারি পরিচালনা করা হয়েছে।
উক্ত শুমারির প্রাপ্ত তথ্যে সরকারি ও উক্ত জরিপের মধ্যে বিরাট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই আদিবাসীদের নিয়ে পুনরায় একটি পৃথক জনশুমারি পরিচালনা করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় ও সংরক্ষণ করতে হবে।
এসএম