tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
মতামত প্রকাশনার সময়: ২৭ এপ্রিল ২০২২, ১৩:০৪ পিএম

বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের আশঙ্কা আমাদের সতর্ক থাকতে হবে


খাদ্য

আবদুল লতিফ মন্ডল: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস সম্প্রতি বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বেড়ে চলা খাদ্য সংকট বিশ্বকে একটি মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।


তিনি আরও বলেছেন, বিভিন্ন দেশের সরকারের জন্য এটি একটি রাজনৈতিক সংকটেও পরিণত হচ্ছে, যারা এ সংকটটি মোকাবিলায় কিছুই করতে পারছে না। এর জন্য তারা দায়ী নয়, অথচ তারা দেখছে দাম বেড়েই চলছে। এদিকে আগামী মৌসুমে (২০২২-২৩) খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক মজুত কমার পূর্বাভাস দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইন কাউন্সিল (আইজিসি)।

সম্প্রতি প্রকাশিত সংস্থাটির এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আগামী মৌসুমে বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের মজুত দাঁড়াবে মোট ৫৮ কোটি ১০ লাখ টনে, যা চলতি বছরের হালনাগাদকৃত মজুতের তুলনায় ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বা ২ কোটি ৭০ লাখ টন কম। চলতি বছরের শেষ নাগাদ খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক মজুত ৬০ কোটি ৮০ লাখ টনে দাঁড়াবে। এ পূর্বাভাস সত্য হলে তা হতে যাচ্ছে ২০১৫ সালের পর সবচেয়ে কম বৈশ্বিক মজুত। ২০১৫ সালে খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক মজুতের পরিমাণ ছিল ৫৫ কোটি ৩৭ লাখ টন। খাদ্য রপ্তানিকারক দুই দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘাতের কারণে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফপিও)। সংস্থাটি বলেছে, ২০২২-২৩ সালে ইউক্রেনে খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস পাবে, কারণ দেশটির ২০ থেকে ৩০ শতাংশ জমি অনাবাদি থাকবে। আর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রধান ডেভিড বিসলি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যের দাম এতটাই বেড়ে যেতে পারে যে তা বিশ্বের দরিদ্র মানুষের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন দুটি দেশই খাদ্যশস্যের বড় রপ্তানিকারক। যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং খাদ্যের দাম বাড়ছে। এ কারণে এখন বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি এবং ন্যাটো জোটের নেতৃত্বে থাকা দেশগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বক্তব্য থেকে মনে হয়, এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে এবং তা কয়েক বছর পর্যন্ত চলতে পারে। এমনটা হলে বিশ্বে খাদ্য সংকট ভয়াবহ রূপ নেবে। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কৃষ্ণসাগরীয় দেশগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্যশস্য বিশ্ববাজারে সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেন বড় অংশ রপ্তানি করে। দেশ দুটি যৌথভাবে প্রায় ৩০ শতাংশ গম রপ্তানি করে।

আর আন্তর্জাতিক বাজারের মোট ভুট্টার প্রায় ১৩ শতাংশ এককভাবে সরবরাহ করে ইউক্রেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মারাত্মক খাদ্য সংকটে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোতে (মেনা নামে পরিচিত)। তুলনামূলকভাবে কম দামে খাদ্যশস্য আমদানির ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর প্রধান উৎস কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেই সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে।

ইউক্রেনের বন্দর থেকে জাহাজীকরণ এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে মেনাভুক্ত দেশগুলো। মধ্যপ্রাচ্যের লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়াসহ কয়েকটি দেশে খাদ্যশস্য সরবরাহ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। লেবাননে এক মাসের মতো গমের মজুত রয়েছে। খাদ্যশস্যটির ৬০ শতাংশই আসে ইউক্রেন থেকে। ইয়েমেন রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করা খাদ্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। আমদানি ব্যাহত হওয়ায় উত্তর আফ্রিকার তিউনিশিয়া, মরক্কো, মিসরসহ কয়েকটি দেশে খাদ্যশস্য সরবরাহে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এদিকে হাঙ্গেরি ইতোমধ্যে খাদ্যশস্যের রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। বুলগেরিয়া রপ্তানির পরিবর্তে মজুতের জন্য উলটো আমদানির পথে হাঁটছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে একই পথে হাঁটতে পারে খাদ্য রপ্তানিকারক অন্যান্য দেশ, যা বিশ্বে খাদ্য সংকট ভয়াবহ করে তুলবে।

এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এটা ঠিক-দেশের প্রধান খাদ্য চালের চাহিদা মূলত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মেটানো হয়। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের তুলনায় চাল উৎপাদনে নিু প্রবৃদ্ধি হার, বীজ হিসাবে সংরক্ষণ, পশুখাদ্য হিসাবে ব্যবহার এবং কাটা-মাড়া থেকে শুরু করে খাবার হিসাবে পরিবেশন পর্যন্ত অপচয় প্রভৃতি কারণে উৎপাদিত চালে আমাদের চাহিদা মিটছে না। এসব কারণে আমাদের প্রায় প্রতিবছর বেশকিছু পরিমাণ চাল উচ্চমূল্যে আমদানি করতে হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম ঊর্ধ্বমুখী, যে কারণে বাংলাদেশকে অধিক মূল্যে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে চাল রপ্তানিকারক দেশগুলো থেকে পণ্যটির রপ্তানি হ্রাস পেতে পারে, যা এটির দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী করবে।

ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গম ও ভোজ্যতেলের পাশাপাশি সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশ এসব পণ্যের চাহিদা অনেকটাই আমদানির মাধ্যমে মেটায়। দেশে খাদ্যশস্যের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গমের বার্ষিক চাহিদা কম-বেশি ৭০ লাখ টন। আর দেশে উৎপাদিত গমের পরিমাণ ১২-১৩ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই দেশে গমের চাহিদা মেটানোর প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমদানি। বিশ্বের যে কয়টি দেশে সবচেয়ে দ্রুত হারে গমের আমদানি বাড়ছে, এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। গত কয়েক বছরে গম আমদানির তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশে গমের মোট চাহিদার পাঁচভাগের চারভাগ মেটানো হয়েছে আমদানির মাধ্যমে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে গম আমদানিতে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ৪৯৪, ১ হাজার ৪৩৬ এবং ১ হাজার ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যসচেতনতার কারণে বেড়ে চলেছে গমের ব্যবহার। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিুবিত্ত-সব শ্রেণির ভোক্তার খাদ্য তালিকায় গম তথা আটা-ময়দা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। একদিকে দেশে গমের চাহিদা বাড়ায় আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধিতে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির আকাশছোঁয়া দামে ভোক্তারা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাছাড়া উচ্চমূল্যে পণ্যটির আমদানি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে রেকর্ড উচ্চতায় সয়াবিন তেলের দাম। আইএফপিআরআইএ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ তার ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় সবটাই হয় কাঁচা বা প্রক্রিয়াজাত পণ্য (প্রাথমিকভাবে পাম তেল ও সয়াবিন তেল) অথবা আমদানি করা তৈলবীজ (রেপসিড ও সয়াবিন) আকারে আমদানি করে, যা অভ্যন্তরীণভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। প্রধান ভোজ্যতেল রপ্তানিকারকদের দ্বারা আরোপিত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বা রপ্তানি কর বৃদ্ধি বাংলাদেশের ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের পাম তেল আমদানির ৮০ শতাংশই সরবরাহ করে ইন্দোনেশিয়া। গত মার্চে ইন্দোনেশিয়া পাম তেল এবং তার সহ-পণ্যের জন্য একটি প্রগতিশীল রপ্তানি শুল্ক বাস্তবায়ন করেছে। অতিসম্প্রতি দেশটি পাম তেল রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করেছে, যা বিশ্ববাজারে এর মোট সরবরাহে প্রভাব ফেলবে। এদিকে বাংলাদেশের সয়াবিন আমদানির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আর্জেন্টিনা থেকে সরবরাহকৃত। গত মার্চের শেষ সপ্তাহে আর্জেন্টিনা সয়াবিন তেল ও খাবারের রপ্তানির ওপর রপ্তানি কর ৩১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৩ শতাংশ করে। এসব কারণে ভোজ্যতেলের দাম রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছে এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য আমদানিব্যয় বাড়িয়েছে।

বাংলাদেশের কৃষি, বিশেষ করে ধানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে সারের ওপর নির্ভরশীল। আইএফপিআরআইএ’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়া ও বেলারুশ প্রধান বৈশ্বিক সার রপ্তানিকারক দেশ। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক রাশিয়ার ওপর আরোপিত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এ বাজারগুলোকে ব্যাহত করেছে। বাংলাদেশ তার পটাশ চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ রাশিয়া (৩৪ শতাংশ) ও বেলারুশ (৪১ শতাংশ) থেকে আমদানি করে। সারের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে অন্য দেশ থেকে পণ্যগুলো আমদানি করতে হবে এবং এতে বেশি দাম দিতে হবে। এ কারণে সারের ব্যবহার কম হবে, বিশেষ করে নাইট্রোজেনভিত্তিক সারের, যা চালের উৎপাদন হ্রাস এবং চালের আমদানি বৃদ্ধি করতে পারে। উপরন্তু, বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য হারে ভুট্টা ও সয়াবিন আমদানি করে। বিশ্বব্যাপী এ পণ্যগুলোর দাম বাড়ছে। এতে দেশের হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু ও মাছের খাবারের পণ্যগুলোর উৎপাদন খরচ বাড়বে। আগামী দিনে প্রাণীজ পণ্যের সহজলভ্যতা হ্রাস এবং গম, ভোজ্যতেল ও চালের মতো পণ্যগুলোয় উচ্চমূল্য এবং সরবরাহ বিঘ্নতা খাদ্যনিরাপত্তাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

এ অবস্থায় যা প্রয়োজন তা হলো খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে প্রধান খাদ্য চাল, গম, ভোজ্যতেল, দুধ, সার বেশি করে উৎপাদন করা। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছেন। এসব খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে না পারলে আমাদের ভোগান্তি বহুগুণ বাড়বে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক
[email protected]

এইচএন