tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
অর্থনীতি প্রকাশনার সময়: ০৯ জুন ২০২২, ০৮:৫২ এএম

সংকট কাটিয়ে উন্নয়নের ধারায় ফেরার বাজেট


বাজেট

করোনাভাইরাসের প্রভাবে লন্ডভন্ড অর্থনীতির গতি ফেরাতে তৎপর গোটা বিশ্ব। সেই তৎপরতা রয়েছে বাংলাদেশেও। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অনেকটাই স্থিতিশীল। ধারাবাহিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গোটা বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। এবার করোনার ধাক্কা সামলে সেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ফেরার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।


বৃহস্পতিবার (৯ জুন) টানা চতুর্থবারের মতো সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। এবারের বাজেটের প্রতিপাদ্য ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’। চলতি অর্থবছর বাজেট বরাদ্দ ছিল ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটের আকার বাড়ছে ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। সামনের অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন করতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি বাজেট (অনুদানসহ) হবে দুই লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর দেশে সব পণ্যের দাম বাড়ায় আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য কিছুটা বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে। বাংলাদেশ অনেকটাই আমদানিনির্ভর দেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। রপ্তানি পণ্যের কাঁচামালসহ নিত্যপণ্যের বড় আমদানি করা হয় প্রতিবছর। ফলে একদিকে যেমন বাড়ছে মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। মার্চ মাসে ছিল ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত দুই বছরে এমন মূল্যস্ফীতি আর ওঠেনি। এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশে। এদিকে গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির বিপরীতে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ হারে। ফেব্রুয়ারি মাসেও মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।

২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ আটটি প্রধান চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছে সরকার। প্রতি বছরের মতো এবারও বাজেট প্রণয়নের অংশ হিসেবে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন, স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সংলাপ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এছাড়া মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং বিভিন্ন সংগঠন থেকে বাজেটের ওপর প্রস্তাবনা এসেছে। সবার সঙ্গে আলোচনা, তাদের প্রস্তাবনা ও মন্ত্রণালয়ের সার্বিক বিশ্লেষণে আগামী অর্থবছরের জন্য আটটি প্রধান চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান, বেসরকারি বিনিয়োগ অব্যাহত রেখে কর্মসৃজন, আমদানি সহনীয় পর্যায়ে রেখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ স্থিতিশীল রাখা, ব্যাংকঋণের সুদহার বর্তমান পর্যায়ে রাখা, রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানো ও বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া এবং সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোর বিষয়গুলো প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সম্প্রতি সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ বাজেটে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, উচ্চ- সব শ্রেণিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। যখন কোনো সিদ্ধান্ত আসে তখন অনেকেই সুবিধাভোগী হন। এখন যদি বড় কাউকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য থাকে যে এখানে কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে কি না। সামাজিক ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা থাকে কি না সেটি দেখা হয়। সুযোগ দিলে যদি কোনো ভালো কিছু হয় তাহলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উপকারভোগী হবেন। এদেরই আমরা প্রাধান্য দিয়েছি।

প্রতিবারের মতো এবারও আয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীলতা থাকবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর। আগামী অর্থবছরের ব্যয় মেটাতে নতুন বছরে কর আদায় করতে হবে তিন লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর কর থেকে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি এবং এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্র ১৮ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর ছাড়া রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এ বছর বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে তিন হাজার ২৭১ কোটি টাকা। তবে বৈদেশিক অনুদান পরিশোধ করতে হয় না বিধায় সেটিকে সরকারের আয় হিসেবে ধরা হয়।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন খাতে চার লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের তুলনায় ছয় হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা বেশি ধরে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। আগামী বছর ব্যাংক থেকে এক লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৬৮ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ৩৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকবহির্ভূত ঋণের মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি ও অন্যান্য জায়গা থেকে পাঁচ হাজার এক কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ খাতে ব্যয় হবে সাত হাজার ২০০ কোটি টাকা।

এদিকে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতির কারণে ওইসব পণ্যে বেশি করে ভর্তুকি দেওয়া হবে। বিশেষ করে সার, খাদ্যপণ্য, বিদ্যুৎ, রপ্তানি পণ্য ও রেমিট্যান্সসহ অন্যান্য খাতে ভর্তুকি এবং প্রণোদনায় ব্যয় করা হবে প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে মূলধনীয় ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বিভিন্ন স্কিমে তিন হাজার ১৫৫ কোটি টাকা, এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পে সাত হাজার ৭২১ কোটি, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে দুই লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি এবং কাজের বিনিয়ময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে (এডিপিবহির্ভূত) ও স্থানান্তরে দুই হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে।

এবারের বাজেটে অর্থনীতি গতিশীল রাখতে দেশীয় শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে কৃষি খাত যান্ত্রিকীকরণ, কর্মসংস্থান ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসৃজনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব থাকবে।

অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, গত ৯ মে প্রধানমন্ত্রীর সামনে বাজেট উপস্থাপনের পর আর তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। এবারের বাজেটে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও সারে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকির চাপ থাকবে। বাজেটে কর্মসৃজন বেশি গুরুত্ব পাবে। তবে এবারের বাজেটে নতুন তেমন কোনো চমক নেই। করোনা-পরবর্তী অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্য নিয়েই এ বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়লেও পরিধি বাড়ানো হয়নি।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেট থেকে দুটি জিনিস দেখতে চাইবো। একটি হলো মূল্যস্ফীতির গোড়ার কারণ। সেই গোড়ার কারণের মধ্যে দুটি কারণ আছে। একটি হলো আন্তর্জাতিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, আরেকটি হলো আমাদের চাহিদা বৃদ্ধি। এখানে বাজেটের যে অবদান থাকে সেটা হলো বাজেট ঘাটতি বেড়ে যায়। চাহিদায় যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কমাতে ঘাটতি বাজেট সহায়ক হবে না। এ বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছর ঘাটতি বাজেট ২০ থেকে ২১ শতাংশ বেশি। বাজেট তো শুধু শুরু, সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী হবে সেটিই দেখার বিষয়। বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধি করাটা সঠিক সংকেত দিচ্ছে না। আমি যদি ঘাটতি গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি রাখি তাহলে যেটা চাই সেটা কিন্তু হলো না।

তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধিতে আমাদের করণীয় কিছু নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধির যে সংক্রমণ আমাদের অর্থনীতিতে হয় সেটাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্য যেমন- গ্যাস, সারের ক্ষেত্রে মূল্য সরকার নির্ধারণ করে। তেলের দামের সঙ্গে কিন্তু বিদ্যুতের দাম সম্পৃক্ত। যদিও বিদ্যুৎ আমরা অল্প আমদানি করি, সেটার তো মূল্যস্ফীতি হয়নি। কিন্তু বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তো এসেছে। সেখানে বাজেটে ভর্তুকি দিয়ে কতটা দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে বা সরকার বাড়াবে না সেটি দেখার বিষয়। দাম না বাড়ালে কিন্তু ভর্তুকি অনেক বেড়ে যাবে। ভর্তুকি প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। তার মানে বাজেটের প্রতি আট টাকার এক টাকা আমরা ব্যয় করছি ভর্তুকির জন্য। সেটা হলে তো অন্যান্য জায়গায় খরচের যে প্রয়োজন, যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা পরিবেশ, কৃষি, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে যে চাহিদা- সেটা কীভাবে সামাল দিচ্ছি। এই ৮৩ হাজার কোটি টাকা যেটা ধরা হচ্ছে সেখানে তো বিদ্যুতের ভর্তুকি অনেকটা বাড়িয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে, সংশোধিত বাজেটে যা ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। এই ভর্তুকি দিলে কি বিদ্যুতের দাম একেবারেই বাড়াবে না, নাকি কিছুটা বাড়াবে। বাড়ালে কখন বাড়াবে? সেটি নিয়ে বাজেট থেকে একটা সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা আশা করবো।

এমআই