রমজানে রাত জেগে ইবাদতের জন্য যা করবেন
Share on:
পবিত্র কোরআনে রাসূল সা. রাত জেগে ইবাদতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে।
الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا। قيم الليل إلا قليلا نصفه أو انقض منه قليلا © أو زد عليه ورئل أيها المزمل
হে বস্ত্রাবৃত, রাতের কিছু অংশ ব্যতীত রাত জেগে সালাত পড়ুন; অর্ধরাত কিংবা তদপেক্ষা কিছু কম, অথবা তদপেক্ষা বেশি। আর কোরআন আবৃত্তি করুন ধীরে ধীরে-সুস্পষ্টভাবে। (সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত : ১-৪)
কোরআনে বর্ণিত রাত জাগার সুর্বণ সময় হলো রমজান মাস। রমজান মাসের মূল ইবাদত রোজা পালন করা হয় দিনভর। রাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে নামাজ পড়া হয়। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে রাত জেগে নামাজ পড়ার নির্দেশই দিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও রবের সেই আদেশ পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করেছেন। রাতে দীর্ঘ সময় ধরে ইবাদত করেছেন। রবের দরবারে অশ্রু নিবেদন করেছেন এবং খুশু-খুযুর সাথে নামাজ আদায়ে নিমগ্ন থেকেছেন।
আল্লাহ তায়ালা এই দীর্ঘ রাত জাগার প্রতিদান ঘোষণা করে বলেছেন,
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ عَسَى أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُودًا
আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় কর তোমার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে। আশা করা যায়, তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন। (সূরা বনী-ইসরাঈল, (১৭), আয়াত, ৭৯)
যারা প্রকৃত অর্থেই রোজা পালন করে, রামজানের রাতগুলো তাদের কাছে খুব বেশি সংক্ষিপ্ত মনে হয়। কারণ, আনন্দমুখর সময়গুলো কীভাবে যেন ফুরিয়ে যায়। আর নিরানন্দ অবসরের সময় যেন শেষই হতে চায় না। সৎকর্মশীলদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
كَانُوا قَلِيلًا مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ
তারা রাতের সামান্য অংশেই নিদ্রা যায়। (সূরা যারিয়াত, আয়াত, ১৭)
ফলে তাদের রাত হতো সুখময়। রাতের শেষ প্রহরে তাদের অবস্থা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে। (সূরা যারিয়াত, আয়াত, ১৮)
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
وَ الۡمُسۡتَغۡفِرِیۡنَ بِالۡاَسۡحَارِ
শেষ রাতে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী (সূরা আল ইমরান, (৩), আয়াত, ১৭)
মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণ রাতের আঁধারে অঝোরে কাঁদতেন। রবের কাছে ফরিয়াদ করতেন। হৃদয়ের সবটুকু বিনয় ও কোমলতা ঢেলে দিয়ে মিনতি জানাতেন। আবর দিন হলেই জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বিজয় অথবা শাহাদাতের আশায় যুদ্ধ করে যেতেন। হৃদয়ের কঠোরতা ও নির্মমতায় কাফিরদের ধ্বংস করতেন।
অপরদিকে রাতের প্রথমভাগে তাদের ঘর হয়ে উঠত তিলাওয়াত, যিকির, ইসলামী শিষ্টাচার শিক্ষার অনন্য পাঠশালা; কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে আমাদের ঘরগুলো গান-বাদ্য, নাটক-সিনেমা এবং অশ্লীল কর্মকাণ্ডের আখড়ায় পরিণত হয়।
বস্তুত, যখন থেকে আমরা রাত্রি-জাগরণ ও রবের স্মরণে অশ্রুপাত ছেড়ে দিয়েছি তখন থেকে ধীরে ধীরে আমাদের অন্তরগুলো শক্ত হতে শুরু করেছে। ঈমান দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই শত চেষ্টা সত্ত্বেও এখন আর আমাদের চোখে পানি আসে না।
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে নবীজি রামাদানে রাত্রি-জাগরণের ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলেন-
مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
যে-ব্যক্তি রমজানে ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় রাত জাগবে এবং সালাত আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে। (সহিহ বুখারি : ২০০৮; সহিহ মুসলিম : ১৭৪)
রাত জেগে ইবাদত এবং নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে এই আয়াতগুলোও অনুপ্রেরণা হতে পারে—
রাত্রি-জাগরণ ও সালাত আদায়ে উৎসাহ পেতে এই আয়াতগুলোও স্মরণ করা যেতে পারে-
يوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ
যে-দিন মানুষ বিশ্বজগতের প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াবে। (সূরা আল মুতাফফিফীন, আয়াত, ৬)
আরও বলা হয়েছে,
وَحُصِّلَ مَا فِي الصُّدُورِ أَفَلَا يَعْلَمُ إِذَا بُعْثِرَ مَا فِي الْقُبُورِ
তবে কি সে জানে না, যখন কবরে যা আছে তা উত্থিত হবে? এবং অন্তরে যা আছে, তা প্রকাশ করা হবে (সূরা আদিয়াত, আয়াত, ৯-১০)
পাশাপাশি কবরের অন্ধকার, সংকীর্ণতা ও ভীতিকর দৃশ্যও কল্পনা করা যেতে পারে; বরং কল্পনা করাও উচিত; কারণ, রাত জেগে নামাজ আদায় করলে অন্ধকার কবরে তা আলোর প্রদীপ হয়ে জ্বলতে থাকবে। এছাড়াও রাতে নামাজ আদায়ের গুরুত্ব, ফজিলত এবং গুনাহ মাফের কথা স্মরণ করা যেতে পারে।
রাতে ইবাদাতের ক্ষেত্রে পূর্বসূরী আলেমদের পদ্ধতি ছিল বিভিন্ন রকম। কেউ রুকু অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটাতেন, কেউ সিজদায় পড়ে থাকতেন। কেউ দাঁড়ানো অবস্থায় তিলাওয়াত করতে থাকতেন। কেউ কান্নারত অবস্থায় তিলাওয়াত করতেন। আর কেউ একমনে জিকির ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ে নিমগ্ন থাকতেন। এভাবেই তারা সারা রাত কাটিয়ে দিতেন।
পূর্বসূরীরা এভাবেই রমজানে ইবাদত করতেন। কিন্তু বর্তমানে আমাদের মাঝে ইবাদতের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। আমরা তিলাওয়াত করি না। রাত যখন গভীর হয় তখন অলস ও গাফেল মানুষেরা ঘুমিয়ে পড়ে। ক্রীড়া-কৌতুকে মত্ত হয়ে পড়ে। অপরদিকে আল্লাহর মুমিন বান্দা-বান্দীদের অন্তরগুলো তখনো জেগে থাকে। তারা কিছুতেই ঘুমোতে পারেন না। কবরের আজাব ও আল্লাহর শাস্তির ভয়ে তাদের দু-চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরে পড়ে। কবর, হাশর-নাশর ও কঠিন শাস্তির কথা তাদের স্মরণে থাকে, তাই তারা রাতের সময়কে নষ্ট করেন না।
আল্লাহ তায়ালার কাছে তাওফিক চাওয়া উচিত সবার। এক হাদিসে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি তাকে বলেন-
يَا عَبْدَ اللَّهِ، لَا تَكُنْ مِثْلَ فُلانٍ كَانَ يَقُومُ اللَّيْلَ، فَتَرَكَ قِيَامَ اللَّيْلِ
হে আব্দুল্লাহ, তুমি অমুকের মতো হয়ো না, যে একসময় রাত জেগে করে নামাজ আদায় করত; কিন্তু এখন তা ছেড়ে দিয়েছে। (বুখারি, ১১১৪)
এনএইচ