দায়মুক্তি পাওয়া ১১ বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য তলব
Share on:
আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ দায়মুক্তি আইনে অনুমোদন পাওয়া এগার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নথি তলব করা হয়েছে। যৌক্তিক দরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে কি না, কিভাবে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয় কিভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে এসব বিষয়ে পর্যালোচনা করা হবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১) এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিসমূহ পর্যালোচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় রিভিউ কমিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ফাইল তলব করেছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্বাহীদের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো হলো মেঘনাঘাট ৫৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাঘাবাড়ি ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, পটুয়াখালী ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, মোংলা ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যূৎকেন্দ্র, আশুগঞ্জ ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, মানিকগঞ্জ ১৬২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, কড্ড ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, সুন্দরগঞ্জ ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, লালমনির হাট ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, সুতিখালি ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব তথ্য-উপাত্ত ও ডকুমেন্ট কমিটিকে সরবরাহের জন্য বলা হয়েছে।
জানা গেছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের যেসব খাতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বিদ্যুৎ খাত। বিশেষ দায়মুক্তি আইনে বিনা টেন্ডারে গত ১৫ বছরে প্রায় ১০০ বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সরকার সমর্থিত ব্যবসায়ী ও দলীয় কর্মীদের বিনা টেন্ডারে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়ে বিদ্যুৎ খাতে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে। দেশের চাহিদার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা জনগণের পকেট কাটা হয়েছে। খাত সংশ্লিষ্ট বিশ্লেকদের মতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়ে হাজার হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে।
আর এ লুটের ভাগিদার ছিলেন প্রতিমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেতা ও কর্মকর্তারা। প্রথমে জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে বিনা টেন্ডারে উচ্চ মূল্যের কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়। বলা হয়েছিল তিন বছরের জন্য। কিন্তু এটা টানতে টানতে ১৫ বছরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন বছর আর শেষ হচ্ছে না। বার বার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও নানা দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার দেশে গ্যাসের সরবরাহ কমে আসলেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এমনও জায়গায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানো কোনো দিনই গ্যাস সরবরাহের কোনো সম্ভাবনা নেই। অভিযোগ রয়েছে, শুধু কমিশনের জন্যই বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অথচ প্রাথমিক জ্বালানির কোনো নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। এর ফলে বিদ্যুৎ খাতকে আমদানি নির্ভর করে পুরো দেশকেই কঠিন সঙ্কটের মুখে ফেলে দিয়েছে। আবার ভারত থেকে অসম চুক্তির মাধ্যমে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে।
গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান তার কার্যকাল শুরুর প্রথম দিনেই দায়মুক্তি আইন বাতিলের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, এ আইনের অধীনে আর কোনো কাজ দেয়া হবে না। ইতোমধ্যে যেগুলো অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেগুলোর যৌক্তিকতার বিষয়ে তদন্ত করা হবে। আর এ কারণেই জাতীয় রিভিউ কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকে ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। ওই সূত্র জানিয়েছে, রিভিউ কমিটি আলোচ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তিতে অসঙ্গতি চিহ্নিত করলে আর সেই আলোকে তাদের বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করা হবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ দিকে গতকাল জ্বালানি উপদেষ্টা এক বৈঠক শেষে বলেছেন, চলমান জ্বালানি সঙ্কট নিরসনে গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, গ্যাসের রিজার্ভ কমে আসার কারণে জ্বালানি সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। ফলে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। তাই বর্তমান সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম আরো জোরদার করার। গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে ৭টি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৫০টি কূপ খননের পরিকল্পনায় রয়েছে।
ইতোমধ্যে ১৫টি খনন করা হয়েছে এবং সেখান থেকে প্রতিদিন ১৭৬ মিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মিলেছে। তবে পাইপলাইন না থাকায় জাতীয় গ্রিডে এখন ৭৬ মিলিয়ন ঘনফুট দেয়া হচ্ছে। জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে আরো ৩৫টি কূপ খনন করা হবে। এর মধ্যে ১১টি কূপ খনন করবে বাপেক্স, বাকি ২৪টি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কাজ দেয়া হবে। এখন থেকে জিটুজিও করা হবে না, প্রতিযোগিতা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
ফাওজুল কবির বলেন, ২০২৮ সালের মধ্যে আরো ১০০টি কূপ খনন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। স্থলভাগের ৬৯টি কূপে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হবে। এর মধ্যে ৩৩টি কূপে অনুসন্ধান করবে বাপেক্স। আরো ১০টি রিগ ভাড়ার মাধ্যমে অনুসন্ধান করা হবে। বাকি ২৬টি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে করা হবে। ফলে গ্যাস সঙ্কট অনেকটাই কেটে যাবে। এখন থেকে কোনো প্রকল্পের সময় ও অর্থ আর বাড়ানো হবে না বলে জানান তিনি।
এফএইচ