বেনজীরের সহযোগীদের তালিকা করছে দুদক
Share on:
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদকে অবৈধ সম্পদ অর্জনে সহায়তাকারী পুলিশ কর্মকর্তা, ভূমি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদসহ অন্যান্যদের তালিকা করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তালিকা তৈরির পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে।
সাবেক আইজিপি বেনজীরের দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান পরিচালনাকারী দুদক তদন্ত দলের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ৬ জুন বেনজীরকে এবং ৯ জুন তার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবও করেছে দুদক।
ঢাকা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও গাজীপুরের ভূমি অফিসের সাব-রেজিস্ট্রারদের নাম তালিকায় আসতে পারে যেহেতু ওইসব এলাকায় বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের স্থাবর সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে।
পত্রিকায় বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর গত ১৮ এপ্রিল দুদক তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে অনুসন্ধান শুরু করে।
দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘‘বেনজীরের দুর্নীতিতে অনেকে সহযোগিতা করেছেন। কারণ একা এতটা করা সম্ভব ছিল না। তার বেশিরভাগ সহযোগীই পুলিশ সদস্য। গাজীপুরের ভাওয়াল রিসোর্টের মতো কিছু সম্পত্তিতে বেনজীরের সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার অংশিদারত্বও আছে।”
বেনজীর যখন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার, র্যাবের মহাপরিচালক এবং আইজিপি ছিলেন তখন এই পুলিশ কর্মকর্তারা সুবিধা নিয়েছেন।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
দুদকের তদন্ত দলের অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, বেনজীর বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে বেশ কিছু জমি কিনেছেন।
বেনজীরকে এসব জমি পেতে সহায়তাকারী সাব-রেজিস্ট্রারদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।
দুদক সন্দেহ করছে, কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা বেনজীরকে ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা তুলে ফেলতে সহায়তা করেছেন।
বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়ে গত ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি দেয় দুদক। ২০ মে চিঠির জবাব পায় দুদক। তার তিনদিন পর অ্যাকাউন্টগুলো ‘ফ্রিজ’ করা হয়, কিন্তু এর মধ্যেই বেনজীর টাকা তুলে নেন বলে জানা গেছে।
ব্যাংকগুলো এইসব নগদ লেনদেনের প্রতিবেদন এবং সন্দেহজনক অন্যান্য লেনদেনের প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছে কি না, তাও তদন্ত করবে দুদক।
১০ লাখ বা তার বেশি টাকা নগদ লেনদেনের বিষয়ে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিএফআইইউকে রিপোর্ট করতে হয়। লেনদেনে যদি কোথাও সমস্যা মনে হয়, সেক্ষেত্রে সন্দেহজনক লেনদেন হিসেবে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে গাজীপুরের কালীগঞ্জেও বিপুল পরিমাণ জমি কেনা হয়েছে। এসব জমির বেশির ভাগই তিনি কিনেছিলেন হিন্দু ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছ থেকে।
বেনজীর পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে প্রায় ৬০০ বিঘা জমি রয়েছে, যার প্রায় বেশির ভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের। এসব জমিসহ মোট ৬২১ বিঘা ইতোমধ্যে জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এই ৬২১ বিঘা জমি ছাড়াও বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে একটি সাততলা বাড়ি ও বেনজীরের নামে ভাটারায় একটি চারতলা বাড়ির খোঁজ পেয়েছে দুদক। দুদক সূত্র বলছে, ভাটারার বাড়িটি সম্প্রতি বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি।
গাজীপুরের কালীগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এই উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের বেতুয়াটেক গ্রামে বেনজীর ও তার স্ত্রী–সন্তানদের নামে–বেনামে অনেক জমি রয়েছে। ভয় দেখিয়ে পানির দামে এসব জমি কিনে নেন বেনজীর।
গাজীপুর জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, কালীগঞ্জ উপজেলায় বেনজীর ও তার পরিবারের প্রায় ১৮১ বিঘা জমি রয়েছে। তবে দুদক সূত্র বলছে, তারা এখানে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ বিঘা জমির সন্ধান পেয়েছে। আরও জমির খোঁজে অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে।
গাজীপুরে বেনজীর পরিবার জমি কেনা শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে। তখন র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। এসব জমির দলিল বিশ্লেষণ করে দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের মতো গাজীপুরেও তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি কেনেন।
বেনজীর আহমেদ বেশির ভাগ জমি কেনেন আইজিপি (২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর) ও র্যাবের মহাপরিচালক থাকার সময়ে। তিনি র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত।
দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, উত্তরার সাততলা বাড়ির জমিটি রাজউক থেকে বরাদ্দ পেয়েছিলেন জীশান মীর্জার বাবা মনসুর আল-হক। পরে সেই জমি মেয়েকে লিখে দেন মনসুর। একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সেখানে সাততলা বাড়ি বানিয়েছেন বেনজীর। তবে দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, বাড়ি তৈরিতে ব্যাংকঋণের বাইরে আরও টাকা লেগেছে। সেই টাকার উৎসও খোঁজা হবে।
কালীগঞ্জে বেনজীর ও তার পরিবারের প্রায় ৪০টি দলিলে খুঁজে পাওয়া ৫০ বিঘা জমি জব্দ করার উদ্যোগ নিয়েছিল দুদক। কিন্তু পরে দুদক কর্মকর্তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, বেশির ভাগ জমি তিনি ২০২২ সালের দিকে বিক্রি করে দিয়েছেন। এসব জমি কিনেছেন ১০ ব্যক্তি।
ঢাকার পূর্বাচল এলাকার পাশেই কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়ন। ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় এ এলাকায় জমির দাম দিন দিন বাড়ছে। তবে বেনজীর কিনেছিলেন খুব কম দামে।
দুদক কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ করে বেনজীর ও তার স্ত্রী–কন্যার নামে কেনা ২০১ শতাংশ জমির ছয়টি দলিল পেয়েছে। এসব দলিল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০৮ শতাংশ জমির মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি ছিল ১৩১ শতাংশ এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের জমি ছিল ৭৭ শতাংশ।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, তাদের এলাকায় বেনজীর পরিবারের দেড়শ বিঘার বেশি জমি রয়েছে। পরিবারের সদস্য ছাড়াও বেনজীরের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের আত্মীয়স্বজনের নামেও সেখানে জমি রয়েছে। এলাকার মানুষ এলাকাটির নাম দিয়েছেন ‘বেনজীরের প্রজেক্ট’।
এমএইচ