tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
মতামত প্রকাশনার সময়: ২৭ মে ২০২২, ১২:২৮ পিএম

রাজনীতিকদের পরিশুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন


Polititian-2022

এ কে এম শাহনাওয়াজ: আমাদের দেশে দুর্নীতি করাটা এখন অনেকটা অধিকারের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বাস্তব পরিসংখ্যানে দেখা যাবে এ দেশে দুর্নীতিবাজদের মাথার উপর প্রশ্রয়ের শামিয়ানা টানিয়ে দিয়েছেন রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতারা আর প্রশাসনিক ক্ষেত্রের কর্তাব্যক্তিরা।


আবার এসব কর্তাব্যক্তি রাজনৈতিক আশ্রয়েই বলবন্ত হন। এ দুই ক্ষেত্রই এখন দুর্নীতির সূতিকাগার। পিকে হালদাররা কেমন করে পিকে হালদার হতে পারল আর নিরাপদে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশান্তরে পাঠাতে পারল, এর উত্তর খুঁজতে হবে এ দুই ক্ষেত্রেই।

ধর্ম আর রাজনীতির মধ্যে একটি মিল খুঁজে পাই আমি। পৃথিবীর সব ধর্মই মানবতার পক্ষে। শান্তির পক্ষে। কিন্তু অনেক সময়ই সুবিধাবাদী আর লোভী রাজনৈতিক নেতা এবং ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধর্মের নাম ভাঙিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে। নিজেদের লাভ ও লোভের ফসল ঘরে তোলে। অথচ দোষ হয় ধর্মের। মধ্যযুগের গঠন পর্বে ইউরোপে রোমান পোপ ক্ষমতাশালী হয়ে পড়েছিলেন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা চলে আসে পোপের হাতে। ইউরোপের কোন রাজ্যের রাজা কে হবেন, তা নির্ধারণ করতেন পোপ। পোপের এ রাজনৈতিক ক্ষমতা খর্ব করেন তৎকালীন গল অর্থাৎ ফ্রান্সের রাজা শার্লামেন।

ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার উদগ্র বাসনায় খ্রিষ্টান বিশ্বের সঙ্গে মুসলমান শক্তির ক্রুসেড বাধিয়ে দিলেন পোপ দ্বিতীয় আরবান। পোপ জানতেন, ধর্মের নামে যুদ্ধ বলে স্বাভাবিকভাবে এ যুদ্ধের নেতৃত্ব চলে আসবে ধর্মনেতা হিসাবে তার হাতে। চারটি রক্তক্ষয়ী ক্রুসেড সংঘটিত হয়েছিল। পরিশেষে দেখা যায় ধর্ম ছিল উপলক্ষ্য মাত্র। পোপের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার লড়াই ছিল এক্ষেত্রে প্রধান। একইভাবে অর্থের লোভ ধর্মনেতাদের অন্ধ করে দেয়। এক্ষেত্রেও ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করেন তারা।

মধ্যযুগের শেষদিকে এসে পোপ ও পাদ্রি এতটা অর্থলোভী হয়ে ওঠেন যে, চালু করে দেন ইনডালজেন্স বা পাপমুক্তির সনদ প্রথা। রোববার চার্চে গিয়ে পাদ্রির কাছে পাপ স্বীকারের একটি প্রথা রয়েছে খ্রিষ্টান সমাজে। পাপমোচনের জন্য ধর্মগুরু প্রার্থনা করেন। এবার নতুন প্রথা চালু হলো পাপের গুরুত্ব অনুযায়ী পাদ্রির বাক্সে নির্ধারিত টাকা ট্যাক্স হিসাবে দিতে হবে। বিনিময়ে পাদ্রি অর্থ পরিশোধের সনদ দিতেন। এটিই ইনডালজেন্স। মৃত্যুর পর কফিনে দিয়ে দেওয়া হতো সনদটি, পরকালে যাতে পাপমুক্তি হয়। এভাবে ধর্মের নামে ধর্মের অপব্যাখ্যা চলতে থাকে।

মধ্যযুগের বাংলায় ইসলাম ধর্ম শক্ত ভিত্তি পেয়ে যায়। বিপুলসংখ্যক স্থানীয় মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তলোয়ারের জোরে বাংলায় ধর্মান্তকরণ হয়নি। সুফিদের ঈশ্বরপ্রেম ও মানবপ্রেমের বাণী সেন রাজাদের সৃষ্ট প্রেমহীন সমাজে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষ বর্জন করে কট্টর বর্ণবাদী সেন রাজাদের।

ক্ষমতায় এসে তুর্কি সুলতানরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। মানুষের কল্যাণে তারা নিজেদের মেধা ও শক্তি প্রয়োগ করেন। সেন রাজারা এ দেশের মানুষকে অন্ধকারে রেখে ক্ষমতা বহাল রাখতে চেয়েছিল। আর এ জন্য ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল ধর্মকে। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা প্রচার করে সাধারণ মানুষকে অন্ধ করে রাখতে চেয়েছিল তারা।

ধর্মের মতো রাজনীতিও প্রয়োজনীয় ও নিরীহ। এ রাজনীতির ইতিবাচক শক্তির অপব্যবহার করে মানুষের কাছে নেতিবাচক করে ফেলা হয়েছে। এভাবে রাজনীতিকরাই বরাবর ফায়দা নিতে চেয়েছেন। সাধারণ মানুষ মনে করেছে রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে। রাজনীতি নষ্ট হওয়ার বস্তু নয়। নষ্ট রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য যখন রাজনীতির শক্তিকে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে চান, তখন অনেকেই দায় চাপান রাজনীতির ঘাড়ে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার মনোভাব অনেকবারই প্রকাশ পেয়েছে। দুর্নীতিবাজ-অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে আমাদের নতুনভাবে আশাবাদী করে তুলেছেন তিনি। অনেক দুর্নীতিবাজ ধরা পড়েছে। অনেকের চেহারা উন্মোচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্যখানে। গণমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, আবার আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখেও শুনতে পাচ্ছি যে, দলের ভেতর আগাছা-পরগাছা রয়েছে। এবার তা পরিষ্কার করা হবে। কিছুদিন আগে ফরিদপুরে নেতাকর্মীদের সামনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, দলে আর কালোটাকার মালিক ও মুদ্রা পাচারকারীদের দেখতে চান না। এর অর্থ, এসব আগাছা দলে ছিল! আমাদের প্রশ্ন, কাদের ভুলে, দায়িত্বহীনতায় বা কোন গোপন চুক্তিতে আগাছাদের আমদানি ঘটেছে? শুদ্ধি অভিযানে এদের শুদ্ধ করা হবে কিনা, তা জানা প্রয়োজন।

সম্ভবত করোনাকালের আগে এমন শুদ্ধি অভিযানে সিটি করপোরেশনের কয়েকজন কাউন্সিলর গ্রেফতার হয়েছিলেন চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদক রাখার অপরাধে। ক্যাসিনোকাণ্ডের পর কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। গ্রেফতার হওয়া এসব কাউন্সিলর বরাবরই এলাকায় মাস্তান হিসাবে পরিচিত। চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী হিসাবে সবাই চেনে তাদের। তাহলে আমাদের জানতে ইচ্ছা করে, আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সব জেনেও তাদের নমিনেশন দিয়েছিলেন কীভাবে? সন্ত্রাস-দুর্নীতির জন্য যদি তারা গ্রেফতার হন, তবে জেনেশুনে আওয়ামী লীগের নেতারা এদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকলে তাদেরও অন্যায় কিছুমাত্র কম হওয়ার নয়। শুদ্ধি অভিযানের মধ্য দিয়ে আমরা যদি সুস্থ সমাজ ও কালিমামুক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ফিরতে চাই, তাহলে পরিবেশ দূষণমুক্ত না করলে কাক্সিক্ষত সাফল্য আসতে পারে না।

পিকে হালদারের কথায় ফিরে আসি। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারে পিকে হালদার একা দোষী হবেন কেন? এত টাকা তো একদিনে তিনি লোপাট করেননি। তাছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বড় বড় অঙ্কের টাকা লোপাট করা তো সহজ নয়। এসব ক্ষেত্রে নানা ধাপে মনিটরিং ব্যবস্থা কার্যকর থাকার কথা। টাকা ছাড়ের আগে মাথার উপর রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পিকে হালদার যাদের ‘ম্যানেজ’ করেছেন, তাদের তো পর্দার বাইরে আসতে হবে। এদের পর্দা ফাঁস হলেই কি নাটের গুরুদের সন্ধান পাওয়া যাবে? সত্য-মিথ্যা পরের কথা, মানুষ এখন বড় অঘটন ঘটলেই মনে করে এর পেছনে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক শক্তির হাত আছে। সত্য না জেনেই মানুষ এভাবে ভাবে কেন? এর পথ তো ক্ষমতাশালী রাজনীতিকরাই করে দিয়েছেন। বারবার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি আর দুর্নীতি হচ্ছে দেখে বিপন্ন সাধারণ মানুষ ঘরপোড়া গরুর মতো সিঁদুরে মেঘ দেখলে আগুনের কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়। তা না হলে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে কেন সতর্কবাণী দিতে হবে যে, তার নামে চাঁদাবাজি বা প্রতারণা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এর সরল অর্থ-রাজনৈতিক সমাজ বাস্তবতায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে।

মাঝে মাঝেই সংবাদ প্রকাশিত হয় র‌্যাবের পরিচয়ে, পুলিশের পরিচয়ে চাঁদাবাজি, ডাকাতি হচ্ছে। যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি এমন হতো-তারা সবসময়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকে এবং সাধারণ মানুষ তাদের নির্ভরতার আশ্রয় মনে করে, তাহলে সন্ত্রাসী-প্রতারকদের এ ধরনের প্রতারণা করার সাহস হতো না। মানুষও বিশ্বাস করত না। আমরা একান্তে খোঁজ নিলে জানব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সবসময় সৎ ও দৃঢ় অবস্থানে থাকতে পারে না ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতাদের কারণে।

রাজনৈতিক দলের নামধারী ষণ্ডাপাণ্ডাদের প্রতিপালক ও আশ্রয়দাতা সাধারণত এরাই হয়ে থাকেন। হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকবারই দেখেছি, আন্তঃহল বড় বড় ছাত্র সংঘাতের ঘটনা ঘটলে আমাদের আহ্বানে পুলিশ আসে ঠিকই, কিন্তু তারা সাধারণত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যুদ্ধের ময়দানে সন্ত্রাসীদের দেখা যায়। প্রভোস্টের দায়িত্ব নিয়ে ওদের নিবৃত করতে বললেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকে। পরে একান্তে স্বীকার করে, উপরের নির্দেশ নেই। বাকিটা আমরা সহজেই বুঝে নিতে পারি। বেআইনি অস্ত্র হাতে সন্ত্রাস করলেও সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের টিকি ছোঁয়া যাবে না। সব সরকারের সময় এ যেন একটি অলিখিত আইন।

এসব হাজারটা উদাহরণ সামনে এলে একটি সত্যই প্রকাশিত হয়, আর তা হলো, অধিকাংশ অন্যায়ের সূতিকাগার রাজনৈতিক অঙ্গন। তাই সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অর্থপাচারসহ সব ধরনের দুষ্কর্ম থেকে দেশের মানুষকে মুক্তি দিতে হলে আগে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকদের পরিশুদ্ধ হতে হবে। দেশপ্রেমের আগুনে পুড়ে খাঁটি হতে হবে। ভুললে চলবে না, প্রতিদিন রাজনীতিকরা তাদের কৃতকর্মের জন্য সাধারণ মানুষের আস্থা হারাচ্ছেন। অবশ্য আমাদের রাজনীতির মহাত্মনগণ ক্ষমতায় মদমত্ত থাকায় বক্তৃতার ভাষার বাইরে সাধারণ মানুষকে থোড়াই কেয়ার করেন।

কিন্তু সাধারণ মানুষকে অবজ্ঞা করার ফল কখনো ভালো হয় না। যুগে যুগে পৃথিবীর নানা অংশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ সত্যটি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। তাই খ্রিষ্টপূর্ব যুগে এথেন্সের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সলোন, পেরিক্লিস প্রমুখ সাধারণ মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিদেশি তুর্কি সুলতানরা মধ্যযুগে বাংলার ক্ষমতা গ্রহণ করে দিল্লির সুলতানদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। দিল্লির পরবর্তী আক্রমণ থেকে টিকে থাকার জন্য গণশক্তির সমর্থনকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন তারা।

কিন্তু আমাদের দেশে ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা জনগণকে ‘দুধভাতে’ মনে করে নিজেদের কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে চান। শ্রীলংকার রাজাপাকসে পরিবার একসময় জনগণের অভ্যর্থনায় সিক্ত হয়েছিল। ধীরে ধীরে পায়ের তলার মাটি শক্ত মনে করে তুচ্ছজ্ঞান করতে থাকে গণশক্তিকে। সাধারণ মানুষের অন্তক্ষরণের খোঁজ করেনি তারা। অর্থনৈতিক সংকটের মুখে সেই ক্ষোভ বিস্ফোরণ ঘটায়। আমাদের রাষ্ট্রীয় সামাজিক বাস্তবতা শ্রীলংকার সঙ্গে পুরোটা মিলবে না।

আওয়ামী লীগ সরকার অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেছে। দেশের অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে পেরেছে। আবার জনজীবনের অনেক সংকটই দূর করতে পারেনি। আয় বৈষম্য তীব্র হয়েছে, দুর্নীতি মহামারির মতো ছড়িয়েছে। দলীয়করণের উগ্র ছোবল সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলছে। এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব বাস্তবতায় আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভালো-মন্দের যোগ-বিয়োগের ফলাফলটা বিবেচনায় আনতে পারছে না। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলমান আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়ে কল্যাণ চিন্তা না করতে পারলে জনগণের মধ্যে মানসিক স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এইচএন