tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
জাতীয় প্রকাশনার সময়: ১৯ অগাস্ট ২০২৩, ১৬:০৪ পিএম

বাংলাদেশি-রোহিঙ্গা যোগসাজশে সমুদ্রপথে পাচার, মিয়ানমারে নির্যাতন


rab-7

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মা সাইন প্রিন্টিং প্রেসে বড় ভাই আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে কাজ করতো জহিরুল ইসলাম (৩৮)। গত মার্চে দোকানের পাশ থেকে নিখোঁজ হন তিনি। এক মাস পর পরিবার জানতে পারে জহিরুল মিয়ানমারে বন্দী। মুক্তিপণ হিসেবে চাওয়া হয় ছয় লাখ টাকা।


হতবিহ্বল পরিবার অনেক কষ্টে চার লাখ ২০ হাজার টাকা ইসলামী ব্যাংকের একটি একাউন্টে পাঠান। এরপর বিকাশে আরও টাকা পাঠান। নগদ টাকা নিতে এসে চলতি বছরের এপ্রিলে চক্রের আবুল নামে এক সদস্য পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর আড়াইহাজার থানায় মানবপাচারের একটি মামলা করেন জহিরুলের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ। এই খবরে জহিরুলের ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। জানানো হয়, জহিরুল আর জীবিত ফিরবে না।

পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে, শুধু জহিরুল নয়, মালয়েশিয়ায় উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলা থেকে মোট ১৯ জন যুবককে মিয়ানমারে আটকে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। সেখানে বন্দীদশায় নির্যাতনে জহিরুল মৃত্যুবরণ করেন।

পরে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের মূলহোতা মো. ইসমাইলকে (৪৫) তার দুই সহযোগীসহ নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবার ও এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

গ্রেপ্তার বাকি দুজন হলেন, ইসমাইলের সহযোগী মো. জসিম (৩৫) ও মো. এলাহী (৫০)। গ্রেপ্তাররা মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করেছে বলে দাবি র‌্যাবের।

শনিবার (১৯ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছরের ১৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার ১৯ জন যুবক মানবপাচার চক্রের মাধ্যমে টেকনাফ থেকে নৌ-পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় মিয়ানমারের কোস্টগার্ড কর্তৃক আটক হয়। এ ঘটনায় গত ১৫ এপ্রিল আবুল কামলাম আজাদ বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানায় মানবপাচার আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।

পরবর্তীতে অন্যান্য ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা গত ১০ জুলাই নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্ত (ইউএনও) এর কার্যালয়ে গিয়ে তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন করেন।

চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়া পাচার হওয়া জহিরুল ইসলাম গত ২৪ মে মালয়েশিয়ার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পরে গত ২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তার লাশ দেশে নিয়ে আসা হয়। র‌্যাব এ মানবপাচার চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে ও মূলহোতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার ইসমাইল গত ২০০১-২০০৫ পর্যন্ত মালয়েশিয়া অবস্থানকালীন মিয়ানমারের আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল ও জামালের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং সখ্যতা গড়ে উঠে।

পরবর্তীতে ইসমাইল দেশে ফিরে এসে মিয়ানমারের আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল এবং জামালের সঙ্গে যোগসাজশে ১০-১২ জনের একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র গড়ে তোলে ও স্থানীয় এজেন্টদের যোগসাজশে বাংলাদেশে মানবাপাচার চক্রটির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে। অবৈধভাবে মানব পাচার কার্যক্রম শুরু করে।

সে প্রায় ১০-১২ বছর ধরে মানব পাচারের এই চক্রটি পরিচালনা করছে বলে জানা যায়। গ্রেপ্তারকৃত ইসমাইল নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করে এই চক্রের দেশে এবং বিদেশে অবস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে অবৈধভাবে মানবপাচার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে এবং ইতোপূর্বে তিনি কারাভোগও করেছেন।

কমান্ডার মঈন জানান, চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার তরুণ ও যুবকদেরকে কোনও প্রকার অর্থ ও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌঁছানো হবে এবং মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে প্রলোভন দেখাতো। গ্রেপ্তার ইসমাইল, জসিম ও আলম ৩০ হাজার টাকা করে ও চক্রের অন্য সদস্যরা ১০ হাজার টাকা করে রেখে বাকি ২ লাখ ২০ হাজার টাকা মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুলের কাছে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো হতো।

ভাগ্য পরিবর্তন ও উন্নত জীবন যাপনের আশায় যে তরুণ ও যুবকরা মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছা পোষণ করতো তাদেরকে জসিম ও এলাহীসহ চক্রের অন্য সদস্যরা মূলহোতা ইসমাইলের কাছে নিয়ে যেত। তারপর তাদেরকে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের মানবপাচার চক্রের আরেক সদস্য আলমের কাছে হস্তান্তর করতো। টেকনাফের আলম ভুক্তভোগীদের কয়েক দিন রেখে সুবিধাজনক সময়ে তাদেরকে ট্রলারযোগে মিয়ানমারে জামালের কাছে পাঠিয়ে দিতো।

মিয়ানমারে জামাল তার গোপন ক্যাম্পে ভূক্তভোগীদের রেখে নির্যাতন করতেন। নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে তা মূলহোতা ইসমাইলের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করতো।

মুক্তিপণ না দিলে ভুক্তভোগীদের নির্মমভাবে পুনরায় নির্যাতন করা হতো এবং যে সব ভুক্তভোগীর পরিবার মুক্তিপণের টাকা প্রদান করে তাদেরকে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় রশিদুলের নিকট পাঠিয়ে দেয়।

গ্রেপ্তার ইসমাইল নিজের ও অন্যান্য সদস্যদের অংশের টাকা রেখে বাকি টাকা মালয়েশিয়া অবস্থানরত রশিদুলের নিকট মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করতো। পরবর্তীতে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুল ও মিয়ানমারে অবস্থানরত জামাল মুক্তিপনের টাকা তারা সমন্বয় করে ভাগ করে নিতো।

র‌্যাবের কমান্ডার মঈন বলেন, রশিদুল প্রায় ২৫ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ বছর ধরে মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে জানা গেছে।

এমবি