নিয়ন্ত্রণহীন স্বর্ণের বাজার, ১৪ বছরে দাম বেড়েছে প্রায় চার গুণ
Share on:
দীর্ঘদিন ধাপে ধাপে বাড়লেও গত দু’বছর স্বর্ণের বাজারে বিরাজ করছে ব্যাপক অস্থিরতা। এর মধ্যে গত ১৮ মার্চ এক লাফে ভরিতে ৭ হাজার ৬৯৮ টাকা বেড়ে রেকর্ড গড়ে। দেশে বেশির ভাগ আমদানি পণ্যের মুনাফার মোটামুটি হার নির্ধারিত এবং সেভাবেই দর ধরা হয়। স্বর্ণই একমাত্র ‘বলগাহীন পণ্য’, যার দাম নির্ধারণে ব্যবসায়ীরা কোনো নিয়মের ধার ধারেন না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দর নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় স্বর্ণকে ব্যবসায়ীরা ‘শাঁখের করাত’ বানিয়ে ভোক্তার পকেট কাটছেন। তারাই ইচ্ছামতো বিক্রির দর ঠিক করছেন; আবার কেনা কিংবা স্বর্ণালংকার অদল-বদলের হারও বেঁধে দিচ্ছেন। যদিও এ অভিযোগ মানতে নারাজ দেশের বাজারে দাম নির্ধারণের একমাত্র নিয়ন্ত্রক স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)।
সংগঠনের দায়িত্বে থাকা নেতাদের দাবি, বিশ্ববাজারকে মানদণ্ড ধরে দেশে স্বর্ণের দাম সমন্বয় করেন তারা। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাব, ডলার সংকটে বৈধ পথে আমদানিতে জটিলতা, ব্যাগেজ রুলের অধীনে দ্বিগুণ আমদানি শুল্কের কারণে দেশে স্বর্ণের দাম বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণে বর্তমানে বিক্রি ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে যাওয়ায় নিজেরাও ভুক্তভোগী বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে সাধারণত স্বর্ণের দাম বাড়ে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বর্ণের দাম এত বেশি হওয়ার কথা নয়। নিয়মের মধ্যে দাম নির্ধারণ ও কার্যকরী আমদানি নীতিমালা হলে অযৌক্তিকভাবে বাড়ানোর প্রবণতা কমবে। শুল্কহার পুনর্বিবেচনা ও আমদানির জন্য বিকল্প উৎস খোঁজার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে নির্দিষ্ট হার যুক্ত করে দেশে স্বর্ণের দর নির্ধারণ করা যেতে পারে। দ্রুত নীতিমালার অধীনে না আনলে স্বর্ণের বাজার মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
সাধারণত দেশে স্বর্ণের দাম কত হবে, তা নির্ধারণ করে বাজুস। সংগঠনটি বলছে, স্বর্ণসহ মূল্যবান ধাতু সরবরাহকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কিটকো ডটকমের দরের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে দাম বাড়ানো বা কমানো হয়। তবে বাস্তবে দুটি দরে ফারাক থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট গোল্ডপ্রাইসের তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে ৪ আগস্ট প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল ১৯৩২ দশমিক ৯০ ডলার। এটি ২০২০ সালের চেয়ে ১৩৭ ডলার কম। এ হিসাবে বাংলাদেশে এখন স্বর্ণের দাম কম থাকার কথা।
২০২০ সালের আগস্টের শুরুর দিকে করোনাকালে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে এবং প্রতি আউন্স (৩১.১০৩ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এখন পর্যন্ত এটিই ইতিহাসের সর্বোচ্চ দর। বিশ্ববাজারের ঊর্ধ্বমুখী ওই দরের সময়ও বাংলাদেশে স্বর্ণের ভরি ছিল ৭৭ হাজার ২১৬ টাকা। এর সঙ্গে গত বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে নতুন করে ঝুঁকিতে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি। দেশে দেশে হয় মূল্যস্ফীতির রেকর্ড। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে স্বর্ণের দাম। তবে এখনও তা ২০২০ সালের দর স্পর্শ করেনি।
আবার প্রতিবেশী ভারতের দি ইকোনমিক টাইমসের তথ্যমতে, গত বৃহস্পতিবার দেশটিতে প্রতি ভরি স্বর্ণ ৬৫ হাজার ৭৮৫ রুপি, যা টাকায় ৮৬ হাজার ৮৩৬ ছিল। জানতে চাইলে বাজুসের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, ‘ভারতে কেন কম, তা তাদের ব্যবসায়ীরা বলতে পারবেন। আমরা বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে সমন্বয় করি।’
অস্বাভাবিক দর বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পাল্টা প্রশ্ন রেখে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, ধান উৎপাদনের শতভাগ সক্ষমতা সত্ত্বেও পাঁচ বছরে চালে ৩০ টাকা, দ্বিগুণ দামে আটা, ১০০ টাকার সয়াবিন তেল কেন ২০০ টাকা হয়েছে? ডলারের দর না কমলে এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অবসান ছাড়া দাম কমবে না। সত্যি সত্যি চীনও যুদ্ধে জড়ালে ভরি দেড় লাখে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
নীতিমালার বিষয়ে ব্যবসায়ীরাও ইতিবাচক জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার থেকে সিদ্ধান্ত এলে অবশ্যই ব্যবসায়ীরা মেনে নেবেন। তবে দাম তো সরকারই বাড়িয়ে দেয়। বৈশ্বিক পরিস্থিতি ছাড়াও সরকারের শুল্ক বৃদ্ধির কারণেই বেড়ে যায় দাম।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিশ্ববাজারে প্রতিদিন স্বর্ণের দাম ওঠানামা করে। এ জন্য প্রতি সপ্তাহ বা মাসে গড় দাম বের করা সম্ভব। ওই দামের সঙ্গে কিছু মার্জিন যেমন ৫, ৭ বা ৮ শতাংশ কিংবা এমন যা-ই হোক যুক্ত করে দাম ধরা যেতে পারে। এ জন্য নীতিমালা করতে হবে। সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে খাতটি মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে এবং একচেটিয়া দাম নির্ধারণে দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা।
এমবি