বিমান হামলায় গাজায় ২৬০ শিশু–নারী নিহত
Share on:
ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের হঠাৎ হামলার জবাবে গাজা গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযানে নেমেছে ইসরায়েল।
শনিবার থেকে গাজায় বিরামহীন বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না অ্যাম্বুলেন্স থেকে শুরু করে শরণার্থীশিবিরও। বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে শিশু ও নারী থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেল নাগাদ গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৭৭০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৪০ শিশু ও ১২০ জন নারী রয়েছেন।
এদিকে শনিবার থেকে দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ১৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১০০ জন। অন্যদিকে হামাসের হামলায় নিহত ইসরায়েলিদের সংখ্যা ৯০০ ছাড়িয়ে গেছে।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যার অভিযোগ এনেছে মানবাধিকার সংগঠন ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর। ইসরায়েলি বিমান হামলায় মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া গাজার বিভিন্ন এলাকার ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছে সংগঠনটি।
বিরামহীন বিমান হামলার বিষয়টি তুলে ধরে ইউরো-মেড মনিটর বলেছে, বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যার মাধ্যমে ফিলিস্তিন সশস্ত্র সংগঠনগুলোর ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী।
বেসামরিক নাগরিকদের পাশাপাশি ইসরায়েলি হামলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকেরাও প্রাণ হারাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত আটজন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন।’ গতকাল মঙ্গলবার চারজন নিহত হন। শনিবার নিহত হন তিন সাংবাদিক। এ ছাড়া রোববার সাংবাদিক আসাদ শামলাখ নিহত হয়েছেন।
গতকাল সকালে সংবাদ সংগ্রহের সময় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন সাংবাদিক মোহাম্মদ সুবহে ও সাইদ আল-তাবিল। বিকেলে তাঁদের জানাজা হয়েছে।
নিহত আরেক সাংবাদিকের নাম হিশাম নাওয়াজাহ বলে জানিয়েছেন গাজার হামাস সরকারের গণমাধ্যম দপ্তরের প্রধান সালামেহ মারুফ।
গাজায় বহুতল ভবনসহ আবাসিক ভবনের পাশাপাশি বিদ্যালয় ও জাতিসংঘ মিশন পরিচালিত ভবনেও ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে। নিজ দপ্তরের সংগ্রহ করা তথ্যের বরাত দিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার প্রধান ফলকার টুর্ক এ কথা বলেছেন।
এক বিবৃতিতে ফলকার বলেন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন স্পষ্ট—বেসামরিক লোকজন ও বেসামরিক স্থাপনাগুলোর সুরক্ষায় অব্যাহত সতর্কতার বাধ্যবাধকতা হামলার পুরোটা সময়ের জন্যই প্রযোজ্য।
এর আগে স্থানীয় সময় সোমবার দুপুরে গাজা শহরের ঠিক উত্তরে অবস্থিত জাবালিয়া আশ্রয়শিবিরে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। মুহূর্তে আশ্রয়শিবির পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।
জাবালিয়া আশ্রয়শিবিরে থাকেন তরুণ লেখক আসমা তাইয়েহ। গত শনিবার থেকে আশপাশের এলাকা থেকে ভেসে আসে মুহুর্মুহু শব্দ। তবে আসমা কখনো ভাবতে পারেননি, তিনি যে স্থানটিকে ‘বাড়ি’ বলে মানেন, সেই আশ্রয়শিবিরও হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।
সংঘর্ষের চতুর্থ দিন গতকালও ইসরায়েলের বিরামহীন বোমাবর্ষণের মধ্যে সকাল হয় গাজার বাসিন্দাদের। চারদিকে বিধ্বস্ত বাসাবাড়ির ধ্বংসস্তূপ।
গাজার বাসিন্দা শাদি আল-হাসি বলেন, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার কোথাও নিরাপদ আশ্রয়ের জায়গা নেই। তিনি বলেন, ‘আমি রাত একটায় (সোমবার দিবাগত রাত) স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাড়ি ছেড়ে আসি।’
শাদি আল-হাসি বলেন, ‘হামলার ভয়ে পালিয়ে আবার আমরা হামলা হতে পারে, এমন জায়গাতেই যাচ্ছি। সবকিছু দেখে আমরা স্তম্ভিত। গোলা, আগুন আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। গাজায় নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই।’
গাজা সীমান্তবর্তী ইসরায়েলের আশদোদ শহরে অবস্থান করে সংবাদ সংগ্রহ করছেন আল-জাজিরার সাংবাদিক রব রেয়নল্ডস। তিনি বলেন, কয়েক মিনিট পরপরই গাজায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ইসরায়েলি হামলা থেকে বাঁচতে বাসাবাড়ি ছাড়ছেন ফিলিস্তিনিরা। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকার লোকজনই বেশি আশ্রয়শিবিরে উদ্দেশে ছুটছেন। ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে গাজার প্রায় ১০ ভাগের ১ ভাগ মানুষ বাসাবাড়ি থেকে পালিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে ইউএনআরডব্লিউএ বলেছে, বিগত ২৪ ঘণ্টায় অধিকাংশ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ জন ইউএনআরডব্লিউএ পরিচালিত বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে গাজায় আশ্রয়শিবিরে থাকা লোকজনও শঙ্কার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। তাঁরা আসন্ন মানবিক বিপর্যয়ের আতঙ্কে ভুগছেন।
কান্না করতে করতে চার সন্তানের মা জয়নাব মাতের বলেন, ‘সন্তানদের মুখে তুলে দেওয়ার মতো খাবার নেই। সুপেয় পানি তো বিলাসিতা। রাতে আমাদের সন্তানদের শীত থেকে রক্ষার মতো জামাকাপড়ও নেই।’
জয়নাব বলেন, ‘হামলা থেকে বাঁচতে আমরা এই বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু এখানেও আমরা অব্যাহত আতঙ্কের মধ্যে আছি।’
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ। গতকাল মঙ্গলবার মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, মানুষের জীবন ও মর্যাদার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। উভয় পক্ষকে তিনি ‘বিস্ফোরক পরিস্থিতি’ থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানান।
এর আগে গত সোমবার গাজায় সর্বাত্মক অবরোধ আরোপের মাধ্যমে খাদ্য, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। এতে সেখানে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এমবি