বলিউড কিং শাহরুখ খানকে নারীরা কেন এত পছন্দ করেন?
Share on:
অবাক হলেও এটা সত্যি যে অনেক নারীর শাহরুখ প্রেমের সাথে তাদের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের যোগসূত্র রয়েছে।
`শাহরুখ খানকে কেন পছন্দ করো?'- বলিউডের এই সুপারস্টারকে নিয়ে আমার কজন বন্ধুকে সম্প্রতি আমি এই প্রশ্ন করেছিলাম। প্রশ্ন শুনে প্রথমে সবাই যেন থমকে গেল।
কারণ , এই প্রশ্ন তো তারা কখনো ভাবেনি। আমি নিজেও ভাবিনি। কিন্তু সম্প্রতি নতুন প্রকাশিত একটি বই ‘ডেসপারেটলি সিকিং শাহরুখ খান‘ পড়ার পর আমি নিজেও ভাবতে শুরু করি– কেন তাকে আমি পছন্দ করি।
আমার বন্ধুদের উত্তর ছিল নায়ক হিসাবে শাহরুখ `আকর্ষণীয়' যার সাথে নিজেকে মেলানো যায়।
সে `মজা' করতে পারে, বুদ্ধিদীপ্ত ‘ব্যঙ্গ‘ করতে ওস্তাদ, সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে তার কথা প্রকাশ পারে, এবং খ্যাতি এবং অর্থের জন্য তার যে চেষ্টা তা নিয়ে তার কোনো `লজ্জা' বা কুণ্ঠা নেই।
তার অভিনীত চরিত্রগুলো নিয়ে কথা বলতে বলতে, আমার বন্ধুরা বলে শাহরুখ খুব `ম্যাচো' নায়ক হয়তো নয়, কিন্তু সংবেদনশীল এবং যে নারীর প্রেমে সে পড়ে তাকে পাওয়ার জন্য যে কোনো কিছু করার জন্য সে প্রস্তুত।
`মেয়েদের জন্য তার যে ভালোবাসা, তার জন্যই আমরা তাকে ভালোবাসি। এটা সত্যি,`আমার এক বন্ধু বললো। বলেই সে বিস্ময় প্রকাশ করলো যে শাহরুখকে পছন্দ করার এই প্রধান কারণটি সে আগে কখনো ভাবেইনি।
বইটির লেখিকা শ্রায়ানা ভট্টাচারিয়া শাহরুখ সম্পর্কে তার ডজন ডজন নারী ফ্যানকে এই প্রশ্ন করে প্রায় একই উত্তর পেয়েছেন।
তবে অবাক হলেও এটা সত্যি যে অনেক নারীর শাহরুখ প্রেমের সাথে তাদের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের যোগসূত্র রয়েছে।
`কখন, কিভাবে এবং কেন কেন তারা শাহরুখকে পছন্দ করা শুরু করলো –
তার উত্তর দিতে গিয়ে এসব নারী নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে কখন, কিভাবে এবং কেন তাদের হৃদয় ভেঙ্গেছে সে কথা বলেছেন,' বলছেন ভট্টাচারিয়া।
`তাদের স্বপ্ন, উদ্বেগ, তাদের প্রেম এবং সঙ্গী পছন্দ নিয়ে নারীদের যে নিরন্তর লড়াই, যন্ত্রণা তার সাথে যেন কোথাও তাদের শাহরুখ প্রীতির যোগসূত্র রয়েছে।'
লড়াই-অতৃপ্তি থেকে সাময়িক মুক্তি
শ্রায়ানা ভট্টাচারিয়া হঠাৎ করে কোনো সমীক্ষা চালাননি । প্রায় ২০ বছর ধরে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন সময়ে শাহরুখ খানের জনপ্রিয়তা নিয়ে উত্তর ভারতের বহু নারীর সাথে খোলামেলা আলাপচারিতা থেকে লেখক এসব উত্তর পেয়েছেন।
এসব নারীর মধ্যে বিবাহিত, অবিবাহিত, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান- সব ধরণের মানুষ আছেন। তাদের অনেকে পরিবারে সুখী অনেকে অসুখী, অতৃপ্ত।
তাদের মধ্যে অনেক শ্রমজীবী নারীও রয়েছেন। একটি বিষয়ে তাদের মধ্যে মিল – তারা সবাই শাহরুখ খানের ফ্যান।
আমাদের জীবনে শাহরুখ খানের সরব প্রবেশ ১৯৯০ এর দশকে। একই সময়ে ভারতে কোকা-কোলা, কেবল টিভির আগমন। ভারতে নতুন এক ‘উদার অর্থর্নীতির‘ সূচনা তখন।
`আমি সেই সময়ের নারীদের গল্প বলতে চেয়েছি, এবং আমি দেখলাম খান কীভাবে অজান্তে ঐ নারীদের মিত্র হয়ে হাজির হয়েছিলেন,' বলেন মিস ভট্টাচারিয়া।
২০০৬ সালে পশ্চিম ভারতের একটি বস্তিতে আগরবাতি তৈরির কারখানার নারী শ্রমিকদের সাথে কথা বলেছিলেন এই লেখক।
মজুরী নিয়ে তারা খুবই ক্ষুব্ধ-হতাশ ছিলেন। কাজের বিরতির সময় ঐ নারী শ্রমিকদের সাথে তিনি কথা শুরু করেন। জিজ্ঞেস করেন কোন বলিউড নায়ক তাদের সবচেয়ে প্রিয়।
`তারা সোৎসাহে বলতে শুরু করেন কি কি বিষয় তাদের আনন্দ দেয়, এবং তার অন্যতম ছিল শাহরুখ খান,' বলেন ভট্টাচারিয়া।
‘কেন আরো বেশি পুরুষ শাহরুখের মত হয় না‘
তার পরের সমস্ত এই ধরণের সমীক্ষায় মিস ভট্টাচারিয়া দেখতে পেয়েছেন শাহরুখ খানের ফ্যান এই নারীদের প্রায় সবাই শ্রমবাজারে তাদের বৈষম্যের শিকার।
সেই সাথে, ঘরে-পরিবারে তাদের সবাইকেই কম-বেশি লড়াই করতে হয়। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত যেসব নারী শাহরুখের ফ্যান তাদের মুখেও একই কথা শুনেছেন লেখক।
সাধারণ একটি আক্ষেপ এই নারীরা করেছেন - `কেন আরো বেশি পুরুষ শাহরুখের মত হয় না!'
`এই নারীরাই তাকে তারকা বানিয়েছেন। আর তার পেছনে ছিল তাদের নিজেদের নিত্যদিনের বাস্তবতা, তাদের আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, হতাশা' বলেন মিস ভট্টাচারিয়া। পর্দায় নায়িকার প্রতি খানের শতভাগ নিষ্ঠা, মনোযোগ নারীদের আকর্ষণ করে।
তার অনেক চরিত্রে তিনি যেভাবে সম্পর্কের পরিণতি, অনিশ্চয়তা নিয়ে তার উদ্বেগ দেখিয়েছেন `তাতে আকৃষ্ট হয়েছেন নারীরা। কারণ তাদের নিজেদের জীবন নিয়েও তারা সবসময় অনিশ্চয়তায় ভোগেন ।'
পর্দায় আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে শাহরুখ যেভাবে অনেক সময় বেসামাল হয়ে হুহু করে কাঁদেন যেটা বলিউডে বেশ বিরল - তা পছন্দ করেন নারীরা।
কারণ তারা দেখেন শাহরুখ তার আবেগ প্রকাশ করতে, নারীদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে লজ্জা পাননা।
`আমি স্বপ্ন দেখি কাভি খুশি কাভি গাম ছবিতে শাহরুখ যেভাবে কাজলের সাথে কথা বলেছে, তাকে স্পর্শ করেছে আমার সাথে কোনো পুরুষ যদি তেমন করতো! কিন্তু আমার স্বামী এতই রুক্ষ,' বলেন মুসলিম এক নারী পোশাক শ্রমিক।
`ধনী, অভিজাত পরিবারের অসুখী বিবাহিতা এক নারী বলেন তিনি তার ছেলেদের ‘ভালো মানুষ ‘ হিসাবে বড় করতে চান।
তার কাছে ভালো মানুষের সংজ্ঞা : তারা যেন কাঁদতে পারে, শাহরুখ যেমন আমাদের মধ্যে যে ভরসা এবং ভালোবাসার বোধ তৈরি করে, তার ছেলেরাও যেন তাদের স্ত্রীদের মনে একই অনুভূতি তৈরি করতে পারে।'
পর্দায় তিনি মেয়েদের বিরক্ত করছেন বা সহিংস আচরণ করছেন শাহরুখ খানের এসব চরিত্র নিয়ে এসব নারীরা স্বস্তি পাননা। ফ্যান হলেও খানকে যে তারা এ ধরণের চরিত্রে দেখতে চাননা।
এমন নয় যে তারা গ্ল্যামার-নাটক উপভোগ করেননা, কিন্তু পর্দায় খানের ছোট ছোট জিনিস তাদের অনেক বেশি আকর্ষণ করে।
‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে' ছবিটি শাহরুখ খানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবিগুলার অন্যতম। এটি সম্ভবত বলিউডের সবচেয়ে সফল রোমান্টিক চলচ্চিত্র।
ওই ছবি সম্পর্কে শাহরুখের এক তরুণী ফ্যানের মা আমাকে যে কথা বলেন তা আমি কখনও ভাবিনি, লক্ষ্যও করিনি, ‘আমি প্রথমবারের মত ঐ ছবিতে দেখলাম নায়ক ছুরি দিয়ে গাজর ছিলছে।
পরিবারের নারীদের সাথে নায়কের এত হৈচৈ, এত সময় কাটানোর ব্যাপার আমি আগে কোনো সিনেমায় দেখিনি।’ ওই নারীর মতে - এই ব্যাপারটি ছিল অসামান্য রোমান্টিক।
নারী ফ্যানরা যে শাহরুখের প্রতি কোনো যৌন আকর্ষণ বোধ করেননা তা নয়। সেকথা তারা প্রকাশও করেছেন। কিন্তু সেটি ছাড়াও তাকে পছন্দের কারণ হিসাবে ঐ নারীরা আরও অনেক কিছু বলেছেন।
প্রতিদিনের অবিচার, লড়াই এবং হৃদয় ভাঙার বেদনার মধ্যে খান অনেক নারীর জন্য এক ধরণের স্বস্তি, উপশম। তার মত একজনকে নারীরা যে বিয়ে করতে চাইতেন তার কারণ এই নয় যে তিনি একজন বলিউড তারকা।
তার প্রধান কারণ বরঞ্চ তিনি একজন ‘সহানুভূতিশীল বিবেচক‘ পুরুষ।
একজন বিবেচক পুরুষ নারীকে কাজ করার সুযোগ দেয়, টাকা জমানোর সুযোগ দেয়। অন্তত স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা পূরণ না করলেও তা পায়ে দলে দেয়না। এ কারণে তারা শাহরুখের ছবি দেখতে সিনেমা হলে গিয়ে হামলে পড়েছেন।
মিস ভট্টাচারিয়ার বইতে এমন এক সরকারী কর্মকর্তার ভাষ্য রয়েছে যিনি তরুণী বয়সে লুকিয়ে শাহরুখের ছবি দেখেতে গিয়ে মায়ের হাতে মার খেয়েছিলেন।
এক গার্মেন্টস শ্রমিকের কথা রয়েছে যাকে লুকিয়ে শাহরুখের ছবি দেখার জন্য ছোট ভাইদের মুখ বন্ধ রাখতে উৎকোচ দিতে হয়েছে।
এক গৃহকর্মীর কথা রয়েছে যিনি রোববারের গির্জায় প্রার্থনা বাদ দিয়ে টিভিতে শাহরুখের ছাবি দেখার জন্য পাদ্রির কাছে মিথ্যা অজুহাত দিয়েছেন।
‘যখন কোনো নারী বলে যে একজন অভিনেতাকে পছন্দ করে, সে আসলে বলতে চায় ওই অভিনেতার চেহারা, ব্যক্তিত্ব সে পছন্দ করে,’ বলেন ভট্টাচারিয়া। তিনি লিখেছেন এসব নারীরা হয়ত খুব বেপরোয়া বা সাহসী নয়, কিন্তু এ ধরণের পছন্দ প্রকাশ করে তারা তৃপ্তি পায়, তাদের কাছে এটা এক ধরণের বিদ্রোহ। বিছানা-র নীচে পছন্দের নায়কের পোস্টার রেখে দেয় তারা। পর্দায় তার গাওয়া গান শোনে, সেই গানের সাথে তারা নাচে। তার ছবি দেখে তারা বোধ করে কোন ধরণের জীবন তারা চায় বা চেয়েছিল।
যেমন, যে সরকারী চাকুরের কথা বইতে আছে, তিনি একসময় পণ করেছিলেন তিনি এমন এক জীবন তৈরি করবেন যেখানে শাহরুখ খানের ছবি দেখতে কারো কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবেনা।
একজন নারী বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন কারণ চুরি করে খানের ছবি দেখতে যাওয়ার কারণে তার পরিবার তড়িঘড়ি করে এমন একজনের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিল যে ছেলে শাহরুখ খানকে পছন্দ করেনা।
ওই নারী এখন একজন বিমানবালা এবং এমন একজনকে বিয়ে করেছেন যার সাথে তিনি শাহরুখের মিল খুঁজে পান, ‘একই ধরণের আবেগ’ বোধ করেন।
‘এখনকার তরুণীরা নিজেরা খান হতে চান’
সুবিধাজনক আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার কারণে আমার নিজের কাছে বা আমার বন্ধুদের কাছে শাহরুখ খান হয়তো তেমন কোনো নিষিদ্ধ স্বপ্ন বা প্রতিশ্রুতি হননি। কিন্তু মিজ ভট্টাচারিয়ার বইটি পড়ার আগে আমি কখনো অনুধাবনই করিনি যে আমার মা কিংবা মাসী-পিসিরা কেন শুক্রবার হলেই নাইট-শোতে শাহরুখ খানের ছবি দেখতে ছুটতেন।
আমাকেও তারা অনেক সময় নিয়ে যেতেন, কিন্তু সিনেমায় ছোটার ভেতর দিয়ে তাদের ‘বিদ্রোহী’ একটি সত্ত্বার বহি:প্রকাশ যে ঘটতো আমি তখন বুঝিনি।আমাদের অস্থির ছেলেবেলার সাথেও খানের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল। একজন নারী আমায় বলেছেন টিভিতে শাহরুখের সাক্ষাৎকার দেখে তিনি ভালো ইংরেজি শিখেছেন। আমার কথা যদি বলি, শাহরুখ আমাকে হিন্দি শিখিয়েছেন।
ভট্টাচারিয়া বলেন শাহরুখ তার সময়ের একজন আইকন। কিন্তু বলিউডে তার আগমনের পর গত ৩০ বছরে সময় অনেক বদলেছে। ‘এখনকার তরুণীরা খানকে বিয়ে করতে চাননা। তারা নিজেরা খান হতে চান। তারা তার মত স্বাধীনতা এবং সাফল্য অর্জন করতে চান।’ তথ্যসূত্র : বিবিসি।
এইচএন