tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
সারাদেশ প্রকাশনার সময়: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১৮ এএম

রংপুরে প্রণোদনা পেতে ভুয়া ছাড়পত্রের ছড়াছড়ি


rangpur-map

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই অর্থ পেতে আহত না হয়েও রংপুরের অনেকে ভুয়া ছাড়পত্র (এমসি) সংগ্রহে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।


আবার এ নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একশ্রেণির দালাল ও প্রতারক চক্র। ইতোমধ্যে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ (রমেক) হাসপাতাল থেকে ২-৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করা শতাধিক ভুয়া ছাড়পত্র জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জমা পড়েছে। এ ছাড়া উপজেলা হাসপাতাল থেকেও ভুয়া ছাড়পত্র সংগ্রহ করে সমাজসেবা কার্যালয় থেকে প্রণোদনা হাতিয়ে নিয়েছেন অনেকে।

রমেক হাসপাতালের রেজিস্টার সূত্রে জানা যায়, গত ১৬ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত ১২২ আন্দোলনকারী আহত হয়ে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ছাড়া আন্দোলনে নিহত ১০ জনের পরিচয় লিপিবদ্ধ রয়েছে।

সরেজমিন রমেক হাসপাতালে গিয়ে ছাড়পত্রের খোঁজ করলে দেখা মেলে দালাল চক্রের একাধিক সদস্যের। কথা হলে তারা জানান, রংপুর সমাজসেবা কার্যালয়ে জমা পড়া কাগজপত্র যাচাই করলে অন্তত শতাধিক ভুয়া আহতদের ছাড়পত্র বেরিয়ে আসবে। ২-৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সিল স্বাক্ষর জাল করে এসব ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। আবার অনেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কিছু ছাড়পত্র জোগাড় করেছেন। তবে হাসপাতালের রেজিস্টার খাতায় এর কোনো তথ্য নেই। এ প্রতিবেদককে ৭ জন ভুয়া আহতের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন তারা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এরা ছাড়পত্র সংগ্রহ করলেও রেজিস্টার খাতায় তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।

কথা হয় আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া পীরগাছার ছাওলা ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক পরিচয় দেওয়া আসাদুজ্জামান আসাদের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৯ জুলাই মিছিলে গিয়ে বিকালে রংপুর পুলিশ লাইন্সের সামনে মাথায় ও পিঠে ১৯টি ছররা গুলি লাগে তার। পরে স্থানীয় ব্রাম্মীকুণ্ডা বাজারের পল্লী চিকিৎসকের কাছে গিয়ে গুলিগুলো বের করেন। এরপর পীরগাছা মেডিক্যালে গিয়ে পল্লী চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেখিয়ে ছাড়পত্র সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন। নগদ দশ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন তিনি। তবে মেডিক্যালে খোঁজ নিয়ে তার চিকিৎসা নেওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

একই ইউনিয়নের কামরুল ও মোতাহার নামে দুজনের বিরুদ্ধে ভুয়া ছাড়পত্র সংগ্রহের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে তারা বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ১৯ জুলাই যুবদলের মিছিলে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তারা। এলাকার ফার্মেসিতে গিয়ে ছররা গুলি বের করেছেন। পরে আলাপের একপর্যায়ে তারা টাকার বিনিময়ে ছাড়পত্র সংগ্রহের কথা স্বীকার করেন। তবে এ বিষয়ে প্রতিবেদন না করার জন্য প্রতিবেদককে হুমকি দেন।

মাইদুল নামে কাউনিয়া টেপামধুপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা জানান, ১৯ জুলাই তার কপালের একদিকে গুলি লেগে আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান হারালে স্থানীয়রা তাকে রমেক হাসপাতালে ভর্তি করে। তার কাছে ছাড়পত্র আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই তারিখে হাসপাতালের রেজিস্টারের কোথাও তার চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য নেই। জানতে চাইলে মাইদুল বলেন, তিনি কিছু জানেন না।

উপজেলা পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গঙ্গাচড়া উপজেলার নাজমুল হাসান লিখন, বদরগঞ্জ উপজেলার জোবায়ের আলম, গাইবান্ধা সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিএনপির সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ভুয়া ছাড়পত্র সংগ্রহ করেছেন।

পীরগাছা ছাওলা ইউপি চেয়ারম্যান নাজির হোসেন জানান, আন্দোলনে তার ইউনিয়নে চারজন (আব্দুল হাকিম, কামরুল, মোতাহার, আসাদ) আহতের ছাড়পত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে হাকিম আহত হয়েছেন ঢাকায়। বাকি ৩ জনের আবেদনের বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘এরা আমার বাড়ির লোক। যুবদল করায় বাড়ি থেকে তারা পালিয়ে ছিল। এরা সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তাদের সব কাগজপত্র আছে।’ তবে ভুয়া ছাড়পত্র সংগ্রহের অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের কারও নামই সংশ্লিষ্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেজিস্টার খাতায় পাওয়া যায়নি।

পীরগাছার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক সুমন জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে আহত-নিহতের তালিকা করা হয়েছে। এরপরও কারও ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পেলে কাগজপত্র পুনরায় যাচাই-বাছাই করা হবে। ইতোমধ্যে আহতদের প্রত্যেককে উপজেলা সমাজকল্যাণ অফিস থেকে দশ হাজার টাকা করে সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। তালিকা মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকেও তারা অনুদান পাবেন।

রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন বলেন, রংপুর মেডিক্যালের রোগী কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে আন্দোলনে আহত ১৫ জনকে জেলা কার্যালয় থেকে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে দশ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে এটি সমাজসেবা কার্যালয়ের গতানুগতিক সহযোগিতার অংশ। মন্ত্রণালয় থেকে এখনও আলাদা বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। ভুয়া ছাড়পত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি যাছাই বাছাই করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সমাজকল্যাণ কর্মকর্তাসহ বাস্তবায়ন কমিটির।

রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, ‘রংপুর জেলায় এখনও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। ভুয়া ছাড়পত্র দিয়ে কেউ যদি সমাজসেবা থেকে টাকা নিয়ে থাকে তাদের নামসহ জানালে যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর অর্থের বিনিময়ে ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেখবে।’

এ বিষয়ে কথা বলতে দুদিন ঘুরেও রমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দায়িত্বশীলরা এ ব্যাপারে কথা বলতে অপারগতা জানান।

এনএইচ