tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
আইন আদালত প্রকাশনার সময়: ২৭ জুলাই ২০২৪, ২১:৩৬ পিএম

আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় মামলা, এজাহারে যা আছে


836988d0-4bff-11ef-838e-d9c9dd6aa145.jpg

কোটা সংস্কার আন্দোলনে গত ১৬ জুলাই গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যু হয়। ওই দিন বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশের গুলি আবু সাঈদের বুকে লাগে।


প্রত্যক্ষদর্শীসহ শিক্ষার্থীরাও অভিযোগ করেন, পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হয়েছেন। কিন্তু মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী বা এফআইআর-এ পুলিশ দাবি করেছে, আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়নি।

এফআইআর-এ পুলিশ যা দাবি করেছে

আবু সাঈদের মৃত্যুর পরদিন ১৭ জুলাই রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের তাজহাট থানায় এ ব্যাপারে একটি মামলা হয়। বাদী তাজহাট থানার (বেরোবি) পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই বিভূতি ভূষণ রায়। পেনাল কোডের (১৪৩/১৮/৬/৩৩২/ ৩৩৩/৩৫৩/৩৭৯/৪৩৫/ ৪২৭/৩০২/৩৪) ধারায় মামলাটি করা হয়।

মামলার বিবরণে উল্লেখ রয়েছে, বেআইনি জনতা সাধারণ/মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করে গুরুতর জখম, চুরি, ভাঙচুর, ক্ষতিসাধন, অগ্নিসংযোগ ও নিরীহ ছাত্রকে হত্যা করে অপরাধ করা হয়েছে।

মামলার বিবরণে আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ না থাকলেও এতে বলা হয়, এরা উচ্ছৃঙ্খল ২-৩ হাজার আন্দোলনকারী ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্ত। তাদের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির সমর্থিত নেতাকর্মীও রয়েছে।

এতে আরও উল্লেখ রয়েছে, পুলিশ সদস্যদের মারপিট করে তাদের মারাত্মক আহত করে ও সড়ক অবরোধে থাকা উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের মধ্য হতে বেশ কিছু ছাত্রবেশী সুবিধাভোগী রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনরত দুর্বৃত্তগণ বিভিন্ন দিক থেকে বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ও তাদের নিকটে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র হতে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও এপিসি গাড়ির মধ্য হতে কং/১১৮৬ সোহেল তার নামীয় সরকারী ইস্যুকৃত শর্টগান হইতে ১৬৯ রাউন্ড রাবার বুলেট ফায়ার করে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখা যায়। তখন তার সহপাঠীরা তাকে ধরাধরি করে জরুরি চিকিৎসার জন্য বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃত ছাত্রের নাম আবু সাইদ (২৩)।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা যা বলছেন

আবু সাইদ নিহতের ঘটনায় পুলিশ মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মামলার বিবরণে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ মারা গেছেন— এমন কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই। পুলিশের এই প্রতিবেদনকে সাজানো নাটক বলে অভিহিত করেছেন তারা।

সাধারণ ছাত্ররা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ মারা গেলেও এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সুস্পষ্ট মামলা হয়নি। উল্টো নিজেদের দোষ ঢেকে পুলিশ দায়ী করেছে আন্দোলনকারীদের। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন– প্রকাশ্যে বুকে গুলির যে ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারা বিশ্ব দেখল, সেটি কি তাহলে মিথ্যা? তাছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না, ভিডিও দেখলে তার প্রমাণ মিলবে।

এদিকে আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় যেসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল তাতে দেখা যায় তিনি দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন। আর উল্টো দিক থেকে পুলিশ শর্টগান থেকে গুলি ছুড়ছে। একপর্যায়ে আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হলে অন্য শিক্ষার্থীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

যদিও এফআইআরে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন যে ‘বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন দিক থেকে গুলি ছুড়তে থাকে এবং ইটের টুকরো নিক্ষেপ করতে থাকে। একপর্যায়ে এক শিক্ষার্থীকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখা যায়।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে বলেন, তাদের সামনে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। তারা এখন এই হত্যা নিয়ে মিথ্যাচার করছে। ভুয়া ও বানোয়াট তথ্য ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে পুলিশ। আমরা পুলিশের সাজানো এ নাটক মানি না। এই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই সাজানো মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন এমনটাও দাবি তাদের।

যা বলছেন শিক্ষকরা

আবু সাঈদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, হাত, বুক, পিঠ, মুখসহ সাঈদের শরীরের শতাধিক স্থানে বুলেটের আঘাতের চিহ্ন ছিল। মাথার পেছনে ফুটো হয়ে রক্ত ঝরছিল।

সাঈদের শরীর ঝাঁজরা করে দেওয়া সেই পুলিশের বিচার দাবি করে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে পুলিশের লুকোচুরির ঘটনা রহস্যজনক। পুলিশের সেই কর্মকর্তাকে কী শাস্তি দেওয়া হয়েছে, জনগণ তা জানতে চায়।

বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক তাবিউর রহমান প্রধান বলেন, আবু সাঈদ নিহতের ঘটনা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। অথচ এ ঘটনায় সুস্পষ্ট মামলা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট মামলা করেনি। আমরা এতে হতাশ। আমরা ছাত্র হত্যার বিচার চাই।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মতিউর রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কমিটিকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারাও এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। কমিটির প্রধান বলেন, তদন্ত চলমান, শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

আবু সাঈদকে গুলির ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসআই ইউনুস আলীর নাম এসেছে। অনেক চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোনও বন্ধ। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তারাও তার ব্যাপারে তথ্য দিতে রাজি হননি।

যদিও ওই পুলিশ সদস্য এ ঘটনায় জড়িত নয় বলে দাবি করে নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। বুধবার (১৭ জুলাই) ইউনুস আলী নামে ওই পুলিশ সদস্য তার ফেসবুক আইডিতে দেওয়া একটি পোস্টে লিখেন, ‍‘আসসালামু আলাইকুম। আমরা সবাই অবগত আছি যে ‌১৬-০৮-২০২৪ তারিখে পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আনুমানিক বিকেল ৩টায় মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আমার উপর মিথ্যা দায় চাপানো খুবই দুঃখজনক। অথচ গতকাল ১৬ তারিখ সকাল ৮টা থেকে ১৭ তারিখ ভোর ৫টা পর্যন্ত আমার কোন ডিউটিই ছিলো না।’

তিনি আরও লিখেন, ‘আমার ডিউটি ছিল (১৫ তারিখ সন্ধ্যা ৭.০৫ থেকে ১৬ তারিখ সকাল ৮টা পর্যন্ত) পুনরায় ডিউটি শুরু হয় আজ ১৭ তারিখ ভোর ৫টা থেকে এখনও পর্যন্ত রানিং)। আপনাদের বুঝার সুবিধার্তে আমার এই দুইদিনের ডিউটি সি.সি. ফরম ও আমার বর্তমান ছবি সংযুক্ত করলাম। আশা করি আমাকে ভুল না বুঝে আপনারা আসল ব্যক্তিকে খুঁজে বের করবেন। সকলকে ধন্যবাদ।’

এদিকে ওই পুলিশ সদস্য সকালে এই পোস্টটি ফেসবুকে দেওয়ার ২০ মিনিট পূর্বে প্রোফাইল চেঞ্জ করেন। পরে আবার কয়েক মিনিট পর সেই পোস্টটি ডিলিট করে দেন। একই সঙ্গে পূর্বের প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন করে নতুন ছবি পোস্ট করেন। পরে সেটিও সরিয়ে নেন। বর্তমানে তার আইডিটি লক করা রয়েছে। পূর্বের প্রোফাইলে মোটরসাইকেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইউনুস আলীর ছবিতে কালো দাড়ি থাকলে পরে পরিবর্তিত ছবিতে দাড়িতে লাল মেহেদী দেখা যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউনুস আলীর গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা শ্রীরামপুর ইউনিয়নের দাঙ্গাপাড়া গ্রামে। চাকরি সূত্রে পরিবার নিয়ে থাকেন রংপুর শহরে। ঘটনার পর পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন।

এদিকে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান জানান, রংপুরের পরিস্থিতি পুলিশ ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। গত ১৬, ১৮ ও ১৯ জুলাইয়ের সহিংসতার ঘটনায় ১৪ মামলায় এ পর্যন্ত ১৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখাসহ নানাভাবে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয়েছে।

আবু সাঈদ নিহতের বিষয়ে তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটনার পরপরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ওই ঘটনার জন্য যেই দায়ী হোক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আবু সাঈদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। মা-বাবার ৯ সন্তানের মধ্যে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তান ছিল আবু সাঈদ। গত ১৬ জুলাই মঙ্গলবার বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্ক মোড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় মিছিলের সম্মুখে থেকে বুক পেতে দেওয়া আবু সাঈদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে গোটা জেলাজুড়ে।

এমএইচ