শরীরে ২১২ গুলি, চোখ হারাতে বসেছেন হাবিব
Share on:
জুলাইয়ের ১৯ তারিখ। দিনটি ছিল শুক্রবার। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সাধারণ জনতাও। শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হলেও বিবেকের তাড়না ছিল প্রবল। তাই সেদিন মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ছুটে যান হাবিবুর রহমান।
৩০ বছর বয়সী হাবিব পেশায় একজন স্যানিটারি মিস্ত্রি। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে যাওয়া হাবিবের ওপর সেদিন গুলি করে পুলিশ। শর্টগান থেকে ছোড়া গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত হয় হাবিরের পুরো শরীর৷
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড এলাকার ২নং সড়কের বাসিন্দা তিনি। সড়কের পশ্চিম দিকে একটি খালি জমিতে ঘর তুলে পরিবার নিয়ে বসবাস তার। শরীরজুড়ে গুলি নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটেছেন তিনি। তবে জোটেনি ভালো চিকিৎসা।
ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে শুরুতেই ১৯ জুলাইয়ের বর্ণনা দেন হাবিব। বলেন, 'আমি ছিলাম চাঁন মিয়া হাউজিংয়ের এইখানে৷ পুলিশ ধাওয়া দিছে, আমরা ভেতরের গলিতে ঢুকে গেছি। পুলিশ দুই বাড়ির মাঝখানের যে চিপা গল্লি, ওখান থেকে গুলি করছে।'
সেখান থেকে হাবিবকে উদ্ধার করে নেওয়া হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসার জন্য গেলেও সেখানে ভালো চিকিৎসা পাননি বলে অভিযোগ তার৷
সরকারি হাসপাতালে সে সময় আহতদের ওপর চিকিৎসার নামে প্রতারণা করা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। হাবিব বলেন, '১৯ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত ভর্তি রাখছে। ছয় দিনে আমার শরীর থেকে গুলি বাইর করছে তিনটা। গুলি লাগছে ২১২টা। আমগো সবাইরে চার তলায় একটা ওয়ার্ডে রাখছে৷ সব আমার মতো গুলি খাওয়া রোগী। কেউই ঠিক মতো চিকিৎসা পায় নাই।'
শরীর ও পুরো মাথার পাশাপাশি হাবিব গুলিবিদ্ধ হন চোখেও। ডান চোখের মনিতে গুলি লাগে৷ চোখের চিকিৎসার জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে তাকে পাঠানো হয় আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে৷ সেখানেও জোটেনি ভালো চিকিৎসা।
হাবিবের ভাষায়, 'চোখে একটা অপারেশন করছে৷ কিন্তু গুলি বাইর করতে পারে নাই। আমারে তো অপারেশনের সময় অজ্ঞান করে নাই। খালি চোখের ওই জায়গাটা অবস কইরা নিছিলো। কিছু একটা দিয়া চোখটারে ঘুটছে৷ তারপর থেকে ডান চোখে আর দেখি না।'
পরিবার ও প্রতিবেশীদের ভাষ্য, দরিদ্র পরিবারে জন্ম, দরিদ্রতার সঙ্গেই লড়াই করে জীবন চলে হাবিবুর রহমানের। স্যানিটারি মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করে মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হয় তার। থাকেন একটি বস্তির ঘরে। সেখানে ভাড়া দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। বাকি টাকায় বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানের পরিবার চালাতে হয় হাবিবুর রহমানের৷
আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হাবিবকে সরকারি হাসপাতালে চোখের ভালো চিকিৎসা না পেয়ে তাকে বেসরকারি হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। সেখানেও ব্যয় হয়েছে বেশ কিছু টাকা।
হাবিব জানান, গুলি লাগার পর থেকে এক মাসে চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার টাকা। যার মধ্যে ৪০ হাজার টাকা তিনি ঋণ নিয়েছেন প্রতিবেশীদের থেকে।
হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'আমারে দেখার মতো কেউ নাই। আমার দিকে আমার পরিবারটা তাকাইয়া আছে৷ দুইটা বাচ্চা। একটা স্কুলে পড়ে। আরেকটারে ভর্তি করা লাগবে৷ বউ আছে, মা আছে। সবাইরে দেখা লাগে। এক মাস ধইরা কাজ করতে পারি না। কাউরে কিছু বলতেও পারি না।'
হাবিব বলেন, 'হারুন আই হাসপাতালে চোখ দেখাইছি। তারা কইছে, আরও ৭০ হাজার টাকার মতো লাগবে চোখ অপারেশন করাইতে৷ দৈনিক আমার ৪০০ টাকার খালি ওষুধই লাগে৷ কই পাই টাকা? ৪০ হাজার টাকা ধার করছি৷ এখন না হয় কেউ চায় না, কয়দিন পর তো চাইবো। কই থেকে দিমু!'
চিকিৎসার জন্য সমাজের সামর্থ্যবানদের সহযোগী চেয়েছেন এই দিনমজুর।
এমএইচ