tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশনার সময়: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:৫১ এএম

সংঘাত মিয়ানমারে, আতঙ্ক বাংলাদেশ সীমান্তে


mayan

নাছির উদ্দিন শোয়েব : মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে চলমান সংঘাতের জেরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হতাহতের ঘটনা এবং আতঙ্ক বেড়েই চলছে।


সীমান্তের ওপার থেকে আসা গ্রেনেড বিস্ফোরণে এরই মধ্যে বাংলাদেশের দুই নাগরিক নিহত এবং অন্তত পাঁচজন ৮-১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

জব্দ করা হয়েছে চারটি ভারি অস্ত্র ও হ্যান্ড গ্রেনেড। চলমান সংঘাতের জেরে দেশটির সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী-ইমিগ্রেশন পুলিশের (বিজিপি) ৩৫ সদস্য এবং পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার প্রায় তিনশত সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। বিজিপিসহ আরো কয়েকশ’ জন অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে বলে জানা গেছে। ফলে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা প্রশাসন।

এদিকে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, দেশের প্রয়োজনে বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত আছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নবনিযুক্ত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি বিজিবির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমরা কোনোভাবেই নতুন করে আর কোনো রোহিঙ্গা নাগরিককে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেব না। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন দেশটির শত শত নাগরিক।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় থাকা মানুষদের মধ্যে বেশিরভাগই চাকমা ও রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান এবং বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেছেন, সীমন্তবর্তী নাগরকিদের সরিয়ে নিতে ইতোমধ্যে তারা সংশ্লিষ্ট উপজেলার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।

স্থানীয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বান্দরবন জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়ন, কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন ও টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের সীমান্তের ওপারে গতকাল মঙ্গলবারও থেমে থেমে গোলাগুলী চলছিল। দুই জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সীমান্ত সংলগ্ন ওইসব এলাকায় এক লাখের বেশি বাসিন্দা এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আপাতত নিরাপদ দূরত্বে স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টারে তাদের রাখা হবে। আরাকান সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির চলমান সংঘাতে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার পালংখালী, হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সাবরাং সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশিরা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। তারা বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন স্বজনদের বাড়ি ও আশপাশের গ্রামগুলোতে। আরকান আর্মির সঙ্গে এই গৃহযুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ছোড়া গুলী ও মর্টারশেল পড়ছে বাংলাদেশের ভেতরে।

এ কারণে চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন সীমান্তের মানুষ। অবশ্য, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্তে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বলে জানা গেছে। স্থানীয়রা আরো জানান, অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের লোকজন সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক গুলী চালিয়েছে। স্থানীয়দের সাথে বাকবিতন্ডা হলে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে দু’টি হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে মারে। একটি পানিতে পড়ে অবিস্ফরিত থেকে গেলেও অপরটির বিস্ফোরণে মোবারক, আয়ুবুল, কালু, এবং আম্বিয়া নামে চারজন আহত হন। এছাড়াও সীমান্ত থেকে ছোড়া গুলী এসে রহমতের বিল এলাকায় পড়লে আনোয়ার নামে একজন আহত হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ওপারে মিয়ানমার সীমান্তে গত চার দিন ধরে থেমে থেমে মর্টারশেল ও গুলীর শব্দ শোনা যাচ্ছে। সর্বশেষ সোমবার রাতে গোলাগুলীর শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন উখিয়ার পালংখালী এবং টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সাবরাং ইউনিয়নের বাসিন্দারা। উত্তল মিয়ানমারের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। সেখানের গোলা মাঝেমধ্যেই ঢুকে পড়ছে ঘুমধুমে। কয়েকজন হয়েছে হতাহত। এরইমধ্যে দেশটির বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও সেনাসদস্যসহ ২৬৪ জন আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। তবে, সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি)। এমন এক পরিস্থিতিতে সংস্থাটির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সীমান্ত পরিদর্শনে যাওয়ার কথা রয়েছে।

সীমান্তজুড়ে আতঙ্ক: বেওলা খাতুন (৬০) নামে এক বৃদ্ধা জানান, থেমে থেমে শুধু গোলার শব্দ! কান থেকে হাত নামাতেই পারছেন না। হাত একটু সরাতেই গুলীর শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। সীমান্তের ওপাশ থেকে টানা গোলাবর্ষণ ও গুলীর শব্দ। সবার মধ্যেই আতঙ্ক আর সতর্কতা। মাথা বাঁচিয়ে কোনোরকমে বেওলা খাতুনের বাড়ির সামনে যখন এসে পৌঁছালাম, তখন তিনি কানে হাত দিয়ে আছেন। গোলাগুলীর শব্দের মধ্যে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে রীতিমতো চেঁচাতে হলো। এই বৃদ্ধা আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বেওলা খাতুনের সঙ্গে কথা হয় এক গণমাধ্যম কর্মীর সঙ্গে। সীমান্তের ওই এলাকা দিয়ে মিয়ানমারের বিজিপি ও সেনাসদস্যদের অনেকেই পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে তাই বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) সদস্যরা পাহারা দিচ্ছেন।

এপারের উৎসুক লোকজন আর সংবাদকর্মীরাও ভিড় করেছিলেন ওই এলাকায়। সবারই দৃষ্টি সীমান্তদের ওপারে। কেমন আছেন, জানতে চাইলে বৃদ্ধা বেওলা খাতুন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় চেঁচিয়ে বললেন, শুক্রবার থেকে টানা পাঁচ দিন ধরে গুলীর শব্দ আসছে সীমান্ত থেকে। আজ (মঙ্গলবার) সকাল ১০টার দিকে তার ছাদে গুলী এসে পড়ে। এতে ফুটো হয়ে গেছে ঘরের টিন। কখন খারাপ কিছু ঘটে, এই ভয়ে দিন কাটছে তার। গুলীর শব্দ থেকে বাঁচতে বালিশেও কান চাপা দিয়েছেন। বেওলার বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরে মমতাজ বেগমের বাড়ি। বাড়ির উঠানে বসে তিনিও কানে হাতচাপা দিয়ে আছেন। মমতাজ বেগম বলেন, তারা আতঙ্কে আছেন। গুলীর শব্দে পরিবারের ছোট বাচ্চারা কান্না করছে। নিরাপত্তার জন্য তাদের সরিয়ে নেওয়া উচিত। মমতাজের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই মন্তব্য করলেন সানোয়ারা বেগম।

অনুপ্রবেশ করেছে ২৬৪ জন: জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি), মিয়ানমার সেনাবাহিনী, ইমিগ্রেশন সদস্য, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার ২৬৪ জন সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। এদের মধ্যে মঙ্গলবার দুপুরে ৩৫ জন প্রবেশ করেন। বিজিবি জানিয়েছে, আজ দুপুর পর্যন্ত মিয়ানমারের বিজিপি, সেনাসহ অন্যান্য বাহিনীর ২৬৪ জন মিয়ানমার থেকে এসেছেন। তাদের মধ্যে ৩৫ জন আজ দুপুরে পালিয়ে এসেছেন। তাদের আশ্রয়ে দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরমধ্যে ১৫ জন আহত ছিলেন। তাদের মধ্যে ৮ জন গুরুতর আহত ছিলেন। ৪ জনকে কক্সবাজার ও ৪ জনকে চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের বিজিবির পক্ষ থেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।