tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
শিক্ষা প্রকাশনার সময়: ১৭ মে ২০২৪, ০৯:০৫ এএম

দুর্দশা রেখেই প্রাথমিক হচ্ছে অষ্টম পর্যন্ত


image-88632-1715914742
ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীর কাঁঠালবাগানের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে খান হাসান আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান। প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের নির্দেশনায় বিদ্যালয়টিকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা হয়।


তবে সে তুলনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে বিদ্যালয়টিতে। পুরোনো চারতলা ভবনটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তা ভেঙে নতুন ভবন করা হবে—বেশ কয়েক বছর ধরেই তা রয়ে গেছে মুখে মুখে, বাস্তবায়ন হয়নি। নতুন একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ হলেও তা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পরিচালনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। যে কারণে বাধ্য হয়েই পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের নিচতলায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ক্লাস চালু রাখা হয়েছে। যে ভবনটির পলেস্তারা খসে পড়েছে। যে কোনো সময়ই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।

খান হাসান আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রণতি সরকার বলেন, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষ ঠিক আছে। তবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর জন্য সেটি যথেষ্ট নয়। এ জন্য অবকাঠামো বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, নতুন ভবনের ছয়তলার মধ্যে বঙ্গবন্ধু কর্নার, আইসিটি ল্যাব ও শিক্ষকদের রুম বাদ দিলে বাকি চার তলায় দুটি করে ক্লাসে পাঠদান চলছে। আরও শ্রেণিকক্ষ থাকলে দুই শিফটে ক্লাস চালানো যেত। আবার পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন করা হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে কয়েকবার মাটি পরীক্ষা করা হলেও কাজ শুরু হয়নি।

শুধু রাজধানীর এ বিদ্যালয়টিই নয়, প্রাথমিকের স্তর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা বেশিরভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরই চিত্র এমন।

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর রামরামা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, ২০১৩ সালে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার পরও মাত্র ৭ জন শিক্ষক দিয়েই চলছে এ বিদ্যালয়। অথচ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষক প্রয়োজন ৯ জন। আর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আরও তিনজন অতিরিক্ত শিক্ষক প্রয়োজন। এ স্তরে একজন শিক্ষক আছেন, তাও আবার ডেপুটেশনে। সবমিলিয়ে এখানে ৫ জন শিক্ষক সংকট। এর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষের সংকট তো আছেই।

কুমিল্লা সদরের সংরাইশ আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সালমা বানু বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে ১৬ শিক্ষক পদের মধ্যে এখন কর্মরত রয়েছেন ১২ জন। দুটি পদ শূন্য রয়েছে, একজন অননুমোদিত ছুটি নিয়ে বাইরে আছেন, অন্যজন চলতি বছর বদলি হয়ে গেছেন। এ ছাড়া অবকাঠামো সমস্যা ব্যাপক। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালাতে আরও একটি ভবন প্রয়োজন।

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ প্রাথমিকের স্তর অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বৃদ্ধি করে আট বছর অর্থ্যাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। এটি বাস্তবায়নে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অবকাঠামোগত আবশ্যকতা মেটানো এবং প্রয়োজনীয়সংখ্যক উপযুক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা।

তবে ১৩ বছর পেরোলেও সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি সরকার। শিক্ষানীতি অনুযায়ী ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার কাজ শুরু করার কথা; কিন্তু ৬৫ হাজার ৫৬৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ধাপে ধাপে সাতশর মতো প্রতিষ্ঠান অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা হলেও সেগুলোতে বিভিন্ন সংকট রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে তিন ধরনের সংকটের কথা জানা গেছে, যা এখনো রয়েছে। সেগুলো হলো- শিক্ষক সংকট, শিক্ষকের প্রশিক্ষণের অভাব ও অবকাঠামো সংকট।

এসব সংকটের মধ্যেই শিক্ষানীতি অনুসরণ করে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছে সরকার। এতদিন পর্যন্ত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু হওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে ‘অভিভাবকহীন’ বলা হলেও এখন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মসূচিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও একাত্মতা ঘোষণা করেছে।

শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, প্রাথমিকে শতভাগ এনরোলমেন্ট নিশ্চিত হয়েছে, নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে শতভাগ শিক্ষার্থী পেলে সেটি হবে আরেকটি অর্জন। আর মাধ্যমিকে শতভাগ করতে পারলে এসডিজির লক্ষ্য পূরণ হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের একটি প্রাথমিক বৈঠক হয়েছে। তাদের পরবর্তী কর্মসূচি হলো প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত করা। আমরা এর সঙ্গে একমত হয়েছি। প্রাথমিকের ৬৫ হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কমপক্ষে ২০ হাজার প্রতিষ্ঠানকে যদি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নেওয়া যায়, তবে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ের ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠানের চাপও কমবে। আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হলো অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শতভাগ শিক্ষার্থী নিশ্চিত করা।

মন্ত্রী বলেন, শিক্ষার্থী সংখ্যা যত ওপরে ওঠে, তত কমতে থাকে। এর পেছনে বেতনকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শহরাঞ্চলে অনেক প্রতিষ্ঠান ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে অনেক বেশি বেতন নেয়। এটিকে কত কমিয়ে আনা যায় সেটিই চেষ্টা করা হচ্ছে।

সংকটের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, বর্তমানে যারা প্রাথমিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন তারা ১০ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ পান। তাই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব হবে বলে আমাদের মনে হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো যাতে বাড়ানো যায়, সেটিই লক্ষ্য। পিইডিপি-৫ (পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি) প্রকল্পে সেটি সংযুক্ত হতে পারে।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামো ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব থাকলে প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা গেলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ হবে না।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সহকারী উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তা ও ইউআরসি ইন্সট্রাক্টরদের সমন্বয়হীনতার কারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্তর রয়েছে, এমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোই ঠিকমতো মনিটর হয় না। সেখানে প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা হলে মনিটরিংয়ের সংকট আরও বাড়বে। তারা বলছেন, প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা বিদ্যালয়গুলোতে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। শ্রেণিকক্ষ সংকট ও দক্ষ শিক্ষকের সংকট রয়েছে। সেজন্য দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং অবকাঠামো সংকট নিরসন করতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পিইডিপি-৪) ড. উত্তম কুমার দাশ বলেন, করোনার কারণে পিইডিপি-৪ প্রকল্প সংশোধন করে ২০২৫ সাল পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। সে কারণে এই প্রকল্পে আগের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু হওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোর উন্নয়ন হবে না। পিইডিপি-৫ শুরু হলে সেখানে অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ রাখা হবে। তবে এর জন্য বৃহৎ পরিকল্পনা নিতে হবে। কারণ দুই মন্ত্রণালয় বিষয়গুলো সম্পর্কে জানলেও কিছু সিদ্ধান্তের বিষয় রয়েছে। কারণ মন্ত্রণালয় ভিন্ন, অধিদপ্তর ভিন্ন, অবকাঠামোও ভিন্ন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে আমরা সেটি বাস্তবায়ন করব। তিনি বলেন, এখন ৬৯৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি চালু রয়েছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে আরও ১৫৪টি এবং তিন বছরের মধ্যে এক হাজার সরকারি প্রাথমিকে অষ্টম শ্রেণি চালু করা হবে। তিনি আরও বলেন, এই সময়ের মধ্যে পদসৃজন করা হবে, অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এসব কাজ বিশেষ করে অবকাঠামো পিইডিপি-৫ এ বাস্তবায়ন করা হবে, যা ২০২৬ সাল থেকে শুরু হবে।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, পিইডিপি-৫ এর কাজ ২০২৬ সাল থেকে শুরু হবে। এরই মাঝে প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীতকরণের কাজ শুরু হলেও অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু হতে অপেক্ষা করতে হবে আরও প্রায় দেড় বছর। এদিকে শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষানীতি অনুসরণ করে প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা হলে কোনো সংকট থাকবে না।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কোর কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, আমরা শিক্ষানীতি প্রণয়নের আগে গবেষণা করে দেখেছি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণের আগ পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী স্কুলে পাঠদান হলে শিক্ষক সংকটও হবে না, অবকাঠামোরও সমস্যা হবে না। এরপর অবকাঠামো নির্মাণ হলে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা যাবে। আবার নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর নিয়ে যাওয়া হলে স্কুলে এত শিক্ষকের প্রয়োজন হবে না। সব মিলিয়ে শিক্ষক সংকট হওয়ার কথা নয়। সেজন্য জাতীয় শিক্ষানীতিতে কি বলা আছে, তা অনুসরণ করতে হবে। তা না করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা হলে অবকাঠামোসহ অন্যান্য সংকট তো থাকবেই।

এনএইচ