‘আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন’
Share on:
গুম হওয়া পরিবারের স্বজনেরা এখনো পথ চেয়ে আছেন। রাজনীতিক, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ছাড়াও সমাজের উচ্চ স্তরের ব্যক্তিও রয়েছেন এ তালিকায়।
নিখোঁজ হওয়ার পর কেউ কেউ ফিরেও এসেছেন। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। নিখোঁজ ব্যক্তিকে ফিরে পেয়ে স্বজনেরা খুশি হলেও কেন বা কিভাবে কারা এ ঘটনা ঘটালো তা অজানাই থেকে যায়। তবে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির স্বজনদের অভিযোগ- গুম হওয়া অনেকেই আর ফিরে আসেনি। স্ত্রী, সন্তান-বাবা-মা এবং স্বজনেরা এখনো পথ চেয়ে আছেন প্রিয় মানুষটির ফিরে আসার অপেক্ষায়। এভাবেই দিন চলে যায়, কিন্তু ফিরে আসছে না আর প্রিয় মানুষটি।
এরই মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। সারা পৃথিবীতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর গুম হওয়া সব ব্যক্তির জন্য আন্তর্জাতিক সনদ হিসাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়্যারেন্স’ সম্মেলনে যে আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয় তাতে ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করা হয়।
২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর ৩০ আগস্ট গুম হওয়া মানুষগুলোকে স্মরণ এবং সেই সঙ্গে তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য দিবসটি পালন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। আর গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীর পাশাপাশি আছেন সাধারণ লোকজনও। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বন্ধ না হলেও অনেকটাই কমেছে।
এক প্রতিবেদনে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এবং এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেছেন, র্যাবের বিরুদ্ধে স্যাংশনের পর বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- কমে গেছে। ফলে স্যাংশন অনেক জীবন রক্ষার কার্যকর হাতিয়ার বলে প্রমাণিত হয়েছে। স্যাংশনের পর কমে গেছে গুমের ঘটনাও। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে ২ হাজার ৬৮৩টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেছে। এরমধ্যে ২০২১ সালে এই ধরনের হত্যাকা- ছিল ১০৭টি। কিন্তু ২০২২ সালে এ সংখ্যা ৩১ জনে নেমে আসে।
এ বছরের (২০২৩) জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র আট জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশিরা যে মানবিক মূল্য পরিশোধ করছে তা কমাতে আমরা মার্কিন কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস হিউম্যান রাইটস কমিশনকে অনুরোধ করব তারা যেন তাদের পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করে।
জাতিসংঘের তালিকায় গুমের শিকার হওয়া ৭৬ জন: জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বিভিন্ন সময় গুমের শিকার হওয়া ৭৬ জনের একটি তালিকা ২০২১ সালে বাংলাদেশ সরকারকে দেয়। এ বিষয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপে আলোচনা হয়। সর্বশেষ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত ঢাকা সফরের সময় এ তালিকা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন।
মিশেল ব্যাশেলেতের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওয়ার্কিং গ্রুপ ৭৬ জনের যে তালিকা দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১০ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। বাকিদের মধ্যে ১০ জনকে খুঁজে পেতে পুলিশ সহযোগিতা করতে চাইলেও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। বাকি ৫৬ জন ‘পলাতক’ বা নিখোঁজ। অবশ্য সরকার শুরু থেকেই গুমের ঘটনাগুলো অস্বীকার করে আসছে। মিশেল ব্যাশেলেত ১৭ আগস্ট ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো সুরাহার স্বার্থে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।
একই সঙ্গে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানান। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিচেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশে সফর করেছেন। এসময় তিনি গুম ও খুনের অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন বলে জানা গেছে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ব্যাচেলেট ঢাকায় যেদিন নামেন সেদিনেই পরপর সরকারের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর - স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র এবং আইন - সাথে দেখা করে গুম, খুন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জেরে সাংবাদিক হয়রানি নিয়ে তার উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন।
পথ চেয়ে আছেন স্বজনেরা: সম্প্রতি গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা মানববন্ধনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন । মানববন্ধনে এক নারী বলেন, ‘অন্তত এটুক জানান আমার স্বামী আর জীবিত নেই।’ ‘আর কীভাবে বললে আপনারা আমাদের কষ্ট বুঝবেন? কার কাছে আমরা আমাদের যন্ত্রণার কথা বলব? কোথায় প্রতিকার পাব?’ এক শিশুর আকুতি-‘বাবার হাত ধরে আমরা ঈদগাহে যেতে চাই, স্কুলে যেতে চাই। ঈদের আগেই আমাদের বাবাকে ফিরিয়ে দিন’।
আবার গুম হয়ে যাওয়া মায়েরা ফিরে চাইলেন তাদের সন্তানদের। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এ মানববন্ধনের আয়োজন করে। মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী আফরোজা আক্তারের সভাপতিত্বে এই মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, তাদের পরিবারের কেউ গুম হয়েছেন ৫ বছর, ৭ বছর, ১০ বছর এমনকি এক যুগ পেরিয়ে গেছে।
প্রিয়জনকে ফিরে পাননি বলে চোখের পানি ফেলে তারা দাবি জানিয়ে বলেন, আমাদের প্রিয়জনেরা অপরাধী হলে আইনি প্রক্রিয়ায় তার বিচার করুন। শিশুরা কেঁদে কেঁদে বলেছে আমাদের বাবাকে ফিরিয়ে দিন। মানববন্ধনে কান্নায় ভেঙে পড়ে বাবাকে ফিরে চেয়েছে ২০১৪ সাল গুম হওয়া চঞ্চল হোসেনের ছেলে ১০ বছরের আহাদ হোসেন।
২০১৬ সালে গুম হওয়া আনোয়ার হোসেনের মেয়ে রাইসা, ২০১৩ সালে গুম হওয়া কাওসার হোসেনে মেয়ে লামিয়া আক্তার, ২০১৪ সালে গুম হওয়া মফিজুল ইসলামের ছেলে সহিদুল ইসলাম, ২০১৯ সালে গুম হওয়া আনিস ইসলামের মেয়ে ইনাশা সোহেল হোসেনের মেয়ে শাফা হোসেন, সাজেদুল ইসলামের মেয়ে অররা ইসলাম, ২০১৫ সালে গুম হওয়া নুর আলমের স্ত্রী রিনা আলম, ২০১৯ সালে গুম হওয়া ইসমাইল হোসেনে স্ত্রী নাসরিন জাহান, ২০১৩ সালে গুম হওয়া মাহবুব হাসানের ভাই জাহিদ খান।
নুর আলমের স্ত্রী রিনা আলম অভিযোগ করেন তাদের বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা কয়েক দফায় গিয়ে জানতে চান নুর আলম কোথায়? তিনি বলেন আমাদের প্রতি এই নিষ্ঠুর আচরণের করা হচ্ছে কেন? অনেকে বলেন গুম হওয়া মানুষটির খোঁজ নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের কাছে গেল তাদের বলা হয় তিনি বিদেশ চলে গেছেন, অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার সময় সাগরে ডুবে মরেছেন। এভাবে তাদের উপহাস করা হচ্ছে।